বাইরে আদিগন্ত অন্ধকারের নৈরাজ্য।
দরিয়াবিবি একবার বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। আমজাদ ঠিকমত ঘুমাইতেছে কি? আলস্য বশ্যতা মানে না। আবার শুইয়া পড়িল দরিয়াবিবি।
স্মৃতির রোমন্থন আর কোন সান্ত্বনার প্রলাপ নাই অন্ধকারে।
হঠাৎ প্রথম স্বামীর কথা মনে পড়িল দরিয়াবিবির। শুধু কী প্রথম স্বামীর কথা? মোনাদির-মোনাদিরকে সে ভুলিয়া গিয়াছে? মোনাদির হোসেন খাঁ। স্বামী-পুত্রের বড় লম্বাচওড়া নাম রাখিয়াছিল। আকিকার সময় দরিয়াবিবি এই নাম পছন্দ করে নাই। তবুও শেষপর্যন্ত নামটা বড় ভালো লাগিয়াছিল।
দরিয়াবিবির দীৰ্ণ চোখে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জমিতে থাকে। মোনাদির চাচার আশ্রয়ে এখনও কি সাদরে প্রতিপালিত হইতেছে? নিজের সন্তান, তবু এতটুকু অধিকার রহিল না তার।
সঙ্গতিপন্ন কৃষকের পুত্রবধূ। তিনখানা লাঙল চলে। লাখেরাজ জমি অল্প ছিল না। ভাতের অভাব পরিবারে উপলব্ধি করা কারো পক্ষে মুশকিল। একান্নবর্তী সংসারে কাজ সব সময় লাগিয়া থাকিত। সারাদিন পরিশ্রমের পর তবু সেখানে বিশ্রামের আনন্দ ছিল। জোওয়ান স্বামীর মুখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে দরিয়াবিবির সম্মুখে। সংসার রচনার কত কল্পনাই না জমা হইয়াছিল বুকে। বর্তমানে ভবিষ্যৎ শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছু চেনে না।
তোমার কোন কষ্ট নেই তো, দরিয়া?
না।
চাষিবাসীর সংসারের ঝঞ্ঝাট বেশি।
তা থাক।
খোকাটা বড় ঘুমায় তো, দরিয়া।
কাঁদে ভুক পেলে। ঘুমায় তো বাপের মতো। মাথা কুটলেও সাড়া থাকে না।
অন্ধকারে হাসির ঝন্ঝনা বাজিয়াছিল সেদিন।
বড় হোক, ছেলেকে আমি শহরে পাঠাব লেখাপড়া শিখতে। মানুষ হোক, আর কিছু চাইনে। আল্লার কাছে দিনরাত দোয়া মাগি।
শহরে কত খরচ!
তা হোক। এখানে বাজে-খরচা সব কমিয়ে দেব।
তিন বছরের শিশুকে লইয়া এত কল্পনা।
ভাবীদের সঙ্গে তোমার বনে না, এই যা মুশকিল।
ওর বড় ছোট-মন। সারাদিন কত কাজ করি, তবু মার কাছে গিয়ে লাগাবে, তোমার বউ পটের বিবি হয়ে শুয়ে থাকে।
বলুক। তা নিয়ে ঝগড়া ভালো নয়।
স্বামীর কণ্ঠ অন্ধকারে এখনও বাজে। সে-ই শেষ রাত্রি। পরদিন সে গঞ্জে গিয়াছিল। পথে সর্প-দংশন। বাড়ি পৌঁছাইবার পূর্বেই গ্রামের হাটতলায় তার শেষ নিশ্বাস পড়িয়াছিল। প্রাণবান স্বামীর মৃত্যু কোনো বজ্রাঘাত সূচনা করে নাই। মোনাদির বক্ষে ছিল বলিয়া সব সহ্য করিতে শিখিয়াছিল দরিয়াবিবি। শ্বশুর তখনও জীবিত, তাঁর স্নেহ-মমতার আশিস ছিল সান্ত্বনার আর-এক দিক। বৃদ্ধ জবেদ হোসেন মোনাদিরকে মাটিতে নামাইতে দিতেন না। মৃতপুত্রের শোকাগ্নি নিবারণের শেষ উপায়। কিন্তু তিনিও এক ভুল করিয়া গিয়াছিলেন জীবনে। তারই প্রায়শ্চিত্ত দরিয়াবিবি এখনও বহন করিতেছে। শাশুড়ি জীবিত থাকিলে কোনো বিপত্তি দেখা দিত না। দুই মাসের মধ্যে শ্বশুরও জবেদ হোসেনের পথ অনুসরণ করিয়াছিলেন! এক বছর পরে রুক্ষ শক্ত ভূমিতে দাঁড়াইতে হইয়াছিল দরিয়াবিবিকে। যৌথ সম্পত্তি বণ্টন হইতেছে ভাইয়ে ভাইয়ে। কিন্তু এক কানাকড়িরও অধিকার নাই তার। স্বামী পিতার কোলে ইন্তেকাল করিয়াছেন। শরিয়ৎ মত শ্বশুরের সম্পত্তির উপর তার বা মোনাদিরের কোন অধিকার নাই। স্বামীর অন্যান্য ভাইদের নিকট দরিয়াবিবি শেষ আবেদন জানাইয়াছিল, মোনাদিরের ভরণপোষণ কিরূপে নির্বাহ হইবে। কর্ণপাত করে নাই তারা। দরিয়াবিবি মরহুম শ্বশুরের অজ্ঞতার উপর হাজার লানৎ বর্ষণ করিয়াছিল। তিনি জীবিত অবস্থায় এই বণ্টন-ব্যবস্থা করিয়া গেলে পথের ভিখারিনী হইত না সে।
তার কয়েক দিন পরেই দরিয়াবিবি স্বামীর ভিটা পরিত্যাগ করিয়াছিল। দাসীবৃত্তির জীবন তার জন্য নয়। অন্যান্য ভাশুর এবং দেবরেরা তখন চণ্ডালের মতো ব্যবহার করিয়াছিল। মোনাদিরকে তাহারা জোর করিয়া ছিনাইয়া লইল। সেদিনের মর্মান্তিক দৃশ্য দরিয়াবিবির চোখে অগ্নিসহ বিদ্যুতের মতো খেলিয়া বেড়ায়। সারা দুপুর তুমুল কলহের পর সে এক বস্ত্রেই পুত্রসহ স্বামীর ভিটা পরিত্যাগে প্রস্তুত ছিল। পালকির কোনো প্রয়োজন নাই তার। খাট যার ভাঙিয়াছে, ভূমিশয্যা ছাড়া তার আর কী গত্যন্তর আছে?
মোনাদিরকে কোলে করিয়া সে পথে নামিয়াছিল।
একজন দেবর এই সময় ছুটিয়া আসে, ভাবী–ভালো হচ্ছে না। আমাদের বংশের ইজ্জত নষ্ট করছ তুমি।
ইজ্জত? যাদের বিচার নেই, তাদের আবার ইজ্জত?
তুমি এখানে থাকো, কে তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে!
এমন করে আমার থাকার দরকার? তোমাদের বিবিজানদের বাদী হয়ে থাকবার কোনো দরকার নেই। না-খেয়ে দিন কাটবে?
তোমার খাওয়ার অভাব হবে না।
পরের হাত-তোলা খাওয়ার দরকার নেই আমার। রাস্তা ছাড়ো। আমার সম্পত্তি আছে?
কোরান-কেতাবে যা হুকুম আছে, সেইমতো কাজ করছি, আমাদের দোষ দাও কেন? বাপের কোলে বেটা মরলে তার ওয়ারিশানদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকে না।
ওসব হাদিস কালাম আমার কাছে শোনাতে এসো না। মানুষকে পথের ভিখিরি। করতে আল্লা বলে দিয়েছে?
আরো কথা কাটাকাটি।
তবে, ছেলে দিয়ে যাও।
তোমাদের চাকরের অভাব আছে বোধহয়।
বড়ভাবীর ছেলেপুলে নেই, সে মানুষ করবে।
অত ছোটছেলে তো চাকরের কাজে অক্ষম। তা মানুষ করতে হবে বৈকি!
তারই চোখের সামনে মোনাদিরকে ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি আর মুখ পশ্চাতে ফিরায় নাই। অতীতের সমস্ত সম্বন্ধ চুরমার হইয়া যাক। যেন কোনো ক্ষোভ নাই তার।