পাঁচ মিনিট পরে দরিয়াবিবি আমজাদকে প্রশ্ন করে, ঘুম পায়নি তো?
না, মা।
তোর আব্বাকে ডেকে দেখ তো, জেগে আছে?
ফিসফিস্ কণ্ঠে কথা বলে সে।
আব্বা! আমজাদ হাঁকে।
কী আব্বা?
জেগে আছ তুমি?
হ্যাঁ।
দরিয়াবিবি পিতা-পুত্রের সংলাপ শোনে।
আর একবার জিজ্ঞেস কর, শিমুলে গিয়াছিল বিকেলে?
শিমুলিয়া গ্রামের নাম।
আব্বা, তুমি শিমুলে গিয়েছিলে বিকেলবেলা?
জবাব দিল আজহার খাঁ, না।
এইবার দরিয়াবিবি সোজাসুজি স্বামীর সঙ্গে কথা আরম্ভ করিল।
বাচ্চাদুটোর যা হয় করো। পাঁঠা না হয়ে যায়। খুনকারদের ডেকে এনো।
পাঁঠা হবে কেন, ভারি তেজি বাচ্চা।
খবরদার, বেচে ফেলো না যেন মাঠ থেকে। দুজন ব্যাপারী তোমার খোঁজ করছিল।
না।
আজহার খাঁর কণ্ঠস্বর উত্তাপহীন। তামাকের নেশায় ঝিমোয় সে। নঈমা ঘুমে ঢুলিতেছিল, দরিয়াবিবির লক্ষ্য পড়িল তার উপর। ছাগলছানা দুটি উঠানে দৌড়াদৌড়ি করে। আমজাদের লোভ হয়, মার ভয়ে সে চোরা-চাউনি ছোড়ে। আর একটু খেলতে পেতাম, মা, ভারি বজ্জাত। ঠোঁট বাঁকায় আমজাদ।
উঠানের কিনারায় ছানাদুটি কয়েকবার থমকে দাঁড়ায়, কেউ লক্ষ্য করে না।
একটু পরে হঠাৎ একটি লাল জন্তুর ছায়া পড়ে। এই সময় মা শব্দে সকলে চমকিত হইয়া উঠিল।
হতভম্ব হইয়া আজহার চিৎকার দিতে থাকে, শেয়াল, শেয়াল। আ-তু, আ-তু।
কুকুর ডাকে সে প্রাণপণে। একটি ছানা বাড়ির কোলে ফিরিয়া আসিল।
পলকে কী ঘটিয়া গেল, দরিয়াবিবি সহজে উপলব্ধি করিতে পারে না। পাড়ার দুটি কুকুর ছুটিয়া আসিল। কয়েকবার মাটি শোকার পর তারাও উঠানের নিম্নবর্তী জঙ্গলে উধাও হইয়া গেল।
শেয়ালে নিয়ে গেল ছানাটা? দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করে।
লাঠি দাও, আমি পুকুরপাড় দেখে আসি।
উঠানে বাঁশের টুকরা পড়িয়াছিল। আজহার অন্ধকারে আড়াল হইয়া গেল।
প্রাঙ্গণে কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ মাত্র। ডিপা আলোয় দরিয়াবিবি বারবার দেখিতে লাগিল। নঈমা, আমজাদ তার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
বড় বিরক্ত হয় দরিয়াবিবি, সরে যা। হাঁ করে কি দেখছিস সব?
তারপর মা খেদোক্তি আরম্ভ করে। শিয়ালের বংশ উদ্ধার হয় গালিগালাজে। ধাড়ির পাশে যে-ছানাটি ফিরিয়া গিয়াছে সেটা কৃশ। আরো আপপোস করে দরিয়াবিবি। ভালো খাশি ছানাটাই মড়ার শেয়ালের চোখে পড়ল।
আজহার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, পাতি পাতি করে খুঁজেছি। ছোট ছানা। মুখে করে দৌড় মেরেছে শেয়াল।
এত কষ্টই সার হল। আর বছর চার-পাঁচ টাকার মাল হত। খামখা গতরের মেহনত।
নঈমা কান্না জুড়িয়া দিল।
দরিয়াবিবি তার দিকে আদৌ ফিরিয়া চাহিল না।
ছেলেগুলোই বদ। রোজ বিকেল-বিকেল তুলে দিই। আজ ভাবলাম। ছেলেরা খেলা করছে, থাক এখন।
আরো কাল্পনিক সম্ভাবনার কাহিনী আওড়ায় দরিয়াবিবি। শ্রান্ত আজহার ধোঁয়া সেবনে বসিয়া পড়িল পুনরায়।
ছোট ছাগল-শিশু। তবু কারো মনে আনন্দ নাই এই পরিবারে। নৈশ-আহারে আরো বিলম্ব হইল। দরিয়াবিবির মেজাজ বড় কড়া। আমজাদ পর্যন্ত খাওয়ার কথা উত্থাপন করিতে ভয় পাইল। নঈমার কপালে রাত্রে ভাত জোটে না প্রায়ই। আজও তার ব্যতিক্রম দেখা গেল না।
ছাগমাতা উঠানে চিৎকার শুরু করিয়াছে।
দরিয়াবিবি খড় খাওয়াইতে লাগিল ছাগটিকে। অনেকক্ষণ আনমনা কাটিয়া যায়।
দরিয়াবিবির মুখ গম্ভীর। চোখের পাতায় ঢাকা অবনত চোখ দৃষ্টির অগোচরে।
আমজাদ মার কাছে দাঁড়াইয়া থাকে। বক্তব্য মুখ হইতে বাহির হয় না। সে-সাহস নাই তার। হাই তুলিয়া সে করুণ চোখে মার দিকে চাহিয়া রহিল।
তোর ঘুম পেয়েছে? চল, ভাত দিই।
আজহার খাঁ এই সুযোগে সান্ত্বনা দিল : আল্লার কাছে শোকর, দুটো নিয়ে যায়নি।
দরিয়াবিবি ব্যঙ্গ স্বরে বলে, ওই মুখে ফুলচন্দন দিতে ইচ্ছে করে!
দপ্ করিয়া নিভিয়া গেল আজহার খাঁ। কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য করিল না।
অপর ছানাটির গায়ে দরিয়াবিবি হাত বুলাইতে লাগিল। কল্পনা রঙিন হইয়া উঠিল তার।
এমন আনমনা বসিয়া থাকা দুঃখ উপশমের ভালো পথ। শুধু আমজাদের জন্য দরিয়াবিবি ছাগল ও ছানা লইয়া রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইল।
রাত্রে ঘুম আসে না দরিয়াবিবির। সারাদিনের ক্লান্তি, তবু চোখে ঘুম নাই একফোঁটা। আজহার খুব অল্প সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল।
শৃগাল-ভুক্ত ছাগলছানার কথা দরিয়াবিবি সহজে ভুলিতে পারে না। হারাম হইয়া গেল তাহার এত মেহনতের ফল! একটা বকনা গরু দুবছর টানা হইতেছে। তার বাছুরের সঙ্গে কোনো দেখা নাই। কোনোদিন মাঠ হইতে চুরি হইয়া গেলেই বা কী। কোন্ চারা আছে তার? আরও আশঙ্কার জাল দরিয়াবিবি নিজেই বোনে। লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইত সংসার, সে-ও ভালো ছিল। দুঃখের অকূল পাথারে নিমজ্জনের আনন্দ দরিয়াবিবি এই মুহূর্তে অনুভব করে। ঘুমের ঘোরে নাঈমা হাত-পা ছুঁড়িতেছে। বাম হাতের কনুই মায়ের বুকের উপর পড়ে। অন্যদিন হইলে সাদরে ধীরে ধীরে হাত সরাইয়া দিত। আজ দরিয়াবিবি জোরে কচি কনুই ও-পাশ করিয়া দিল। কারো প্রতি কোনো দয়া নাই তার। জানোয়ারের মত ঘুমাইতেছে আজহার। স্বামীর বিছানার আর-একপ্রান্তে সরিয়া আসিয়াছে দরিয়াবিবি। আনমনা সে নঈমার কনুইয়ে আবার হাত বুলাইতে থাকে। মেয়ের ঘুম ভাঙে না।
আমজাদ আসেকজানের কাছে চলিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি বড় হয় না কেন গরিবের ছেলেরা? সংসারের দুঃখ ঘুচিবে সত্ত্বর। আমজাদের মতবের পড়া কবে যে শেষ হইবে! শেষ হইলেও ভাবনার দায় হইতে রেহাই নাই। কাছে কোনো স্কুল নাই। চার মাইল হাঁটিয়া এই দুধের বাচ্চারা ইলেম অর্জন করিবে? নঈমা বড় বাড়ন-সার। গরিবের মেয়ের পক্ষে যা বিপজ্জনক। বিবাহের বয়সের আগেই আবার বিবাহের হাঙ্গামা। দরিয়াবিবি বিভীষিকার পুতুল ভাঙে আর গড়ে।