দারিদ্র্যের উলঙ্গ রূপ দরিয়াবিবির চোখে যেন এই প্রথম ধরা দিল। সে কেন এখানে আসিয়াছে স্বর্ণপুরী হইতে নির্বাসিত রাজনন্দিনীর মতো? সে কেন এখানে আসিয়াছে? পোড়া ক্ষতের জ্বালা অনুভব করে সে। তার চোখেও অশ্রুর প্লাবন নামে।
ফুৎকারে ডিপা নিভাইয়া দরিয়াবিবি অন্ধকারে আসেকজানের কাছাকাছি আসিয়া ডাকিল, খালা!
.
০৪.
গোধূলি বেলা।
উঠানে নঈমা ছাগলছানা লইয়া খেলা করিতেছিল। আজ বেলাবেলি আজহার মাঠ হইতে ফিরিয়াছে। অবসর সময়টুকু এইখানে কাটে তার। বড় নিঃসঙ্গ আজহার। অন্যান্য প্রতিবেশীদের মতো তাস-পাশা খেলিয়া সে সময় অপব্যয় করিতে জানে না। সাংসারিক কথাবার্তা হয় দরিয়াবিবির সঙ্গে। যখন কোনো কাজ থাকে না, একমনে সে গুড়ুক ফোঁকে। আমজাদ দহলিজে থাকিলে কথা বলিবার কোনো ছুতা পাওয়া যায় না। নঈমার সঙ্গে বাক্যালাপের কোনো বিষয় নাই।
ফুটফুটে ছাগলছানা। কালো মিশমিশে গায়ের উপর অস্তমিত সূর্যের লালিমা পড়িতেছে। রঙের পিণ্ড যেন সঞ্চরণশীল। ধাড়ি ছাগলটি খড়ের উপর শুইয়া রহিয়াছে। নঈমা তাই ব্যস্ত।
আরো চঞ্চল ছানা দুটি। একবার মার কাছে ছুটিয়া যায়। দুধের বাট টানে কিয়ৎক্ষণ, তারপর ম্যাঁ-ম্যাঁ শব্দে প্রাঙ্গণে ঘুরিয়া বেড়ায়। পশ্চাতে ছোটে নঈমা। হয়ত সহজে ধরা দিল না। রাগে সে মার কাছে অভিযোগ করে। তখন কৌশল অবলম্বন করিতে হয়। নঈমা আনমনা অন্যদিকে চাহিয়া একটি ছানার উপর জোরে হাত রাখে। ভীত চিৎকার ক্ষণিক। তারপর আদরে গলিয়া যায় ছাগশাবকরা। নঈমা ছানা বুকে করিয়া গায়ের উপর নরম হাত বুলাইতে থাকে। ছাগমাতা ছুটিয়া আসিলে নঈমা সরিয়া যায়।
আজহার খাঁ মেয়ের লীলা-চপল ভঙ্গি দেখে। শুঢুকের ধোঁয়ায় চোখ ফ্যাকাশে। কোনো মন্তব্য তার ঠোঁটে আসে না। দরিয়াবিবি গেরস্থালির অন্যান্য কাজে ব্যস্ত।
একটু পরে আসিল আমজাদ। বগলে একগাদা তালপাতা। মতব হইতে এইমাত্র সে ছুটি পাইয়াছে। দিনের আলোক থাকা পর্যন্ত মৌলবী সাহেব ইলেম-দানে কার্পণ্য করেন না। চপলমতি বালকেরা এই সময় খুব করিয়া নামতা পড়ে।
অনেকক্ষণ পূর্বে আসিত আমজাদ। ছুটির পর তালপাতা থোয়া–আর এক কাজ। রোজ রোজ তালপাতা দপ্তর হারাইলে মা বড় বিরক্ত হয়। কালির দাগ সহজে ছাড়ে না। ডোবার পানি ভালো নয়। এমনি দেরি হইয়া যায়। শুধু ভয়ে আমজাদ কোনো প্রতিবাদ করে না। মখৃতবে যারা কাগজে লেখে তাদের সঙ্গে ইদানীং নিজের তুলনা করিতে শিখিয়াছে আমজাদ।
মন বিষণ্ণ। তাই উঠানে আসিয়া সে চুপিচুপি আজহার খাঁর পাশে বসিয়া পড়ে। মার সঙ্গে কোনো বাক্যালাপ হইল না। কিন্তু নঈমার খেলা দেখিয়া সে সব ভুলিয়া যায়। নিজেও এই খেলায় সানন্দে যোগ দিল।
এইবার ছাগশিশুরা ভীত। আমজাদের সঙ্গে দৌড়পাল্লায় তারা অক্ষম। মা মা শব্দ করে শুধু। ভাইবোনে উঠান মাৎ করিয়া রাখে।
বোধহয় ফুরসৎ পাইয়াছিল দরিয়াবিবি। সেও বাতাসে আসিয়া বসিল।
আমু!
কী মা? জবাব দিল আমজাদ।
বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিসনি, ন্যাটা হয়ে যাবে বাচ্চাদুটো।
না মা, আমি তো বেশি ছুঁইনি।
নঈমা প্রতিবাদ করে : মা, আমি তো খেলা কচছি।
হ্যাঁ, খেলা করো।
সন্ধ্যা নামিতেছে ধীরে ধীরে। উঠানে অন্ধকার ঘন হইয়া আসে। দরিয়াবিবি চুল মেলিয়া দিল বাতাসে। সারাদিনের ক্লান্তি ঘামে আর পরিশ্রমে। হাওয়া লাগুক একটু গায়ে।
উঠানে অন্ধকার। নঈমা ও আমজাদের মাহেন্দ্রক্ষণ। এখন ইচ্ছামতো বকরি ছানাকে আদর করা চলে। যতই জোরে পিঠে দমক দাও না কেন, মার চোখে পড়িবে না কিছুই। কিন্তু ছানাগুলি যা বজ্জাত! আদরের নামে একটু জোরে কোথাও টিপ দিলে বড় ম্যাঁ ম্যাঁ শব্দ করে। মার ধমক দিতে তখন বিলম্ব হয় না।
দরিয়াবিবি বলে, আরে বাবা চৌদ্দপুরুষ, একটু আস্তে ছুটোছুটি কর।
মা, ভারি ডরুক ছানাদুটো। কাছে গেলেই ম্যাঁ ম্যাঁ।
ছাগলের ডাক অনুসরণ করিতে লাগিল আমজাদ। অন্ধকারে আজহার খাঁ নীরবে হাসে। তার অস্তিত্ব সবাই বিস্মৃত হইয়াছে! ঘরের দাওয়ায় ডিপা জ্বলিতেছিল। অস্পষ্ট আলো উঠানে সামান্য পৌঁছায়। ছায়ামূর্তির উপনিবেশ। কেউ কারো মুখ দেখিতে পায় না।
উঠানের নিচে আগাছার বন। খুব ঘন নয়। প্রতিবেশীদের কলাগাছের ঝাড় তারপর কয়েক কাঠা জুড়িয়া। আজহার খাঁ সামান্য সরুপথ পৈঠার সাহায্যে অতিক্রম করে। এই দিকে বিশেষ কোনো কাজ থাকে না। বর্ষার দিকে কতগুলি ডোবায় রাত্রে মাছ ধরিতে যাওয়ার খুব সুবিধা। সেইজন্য পথটুকু।
ছাগলছানারা শ্রান্ত। যা দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। দরিয়াবিবি চুপচাপ বসিয়াছিল।
আজহার খাঁ নিজেই ডিপা হইতে কয়লা ধরাইয়া আনিল। সে ফরমাশ-করা ভুলিয়া গিয়াছে নাকি? হাসে দরিয়াবিবি অন্ধকারে।
পরক্ষণে বড় বিরক্তি লাগে তার ছেলেদের হল্লা।
এই, চুপ কর তোরা।
আমজাদের কোলে একটা ছাগলছানা চিৎকার করিতেছিল। ভয়ে সে বাচ্চা মাটির উপর ফেলিয়া দিল। নূতন প্রাণ পায় ছাগশাবক, মার কাছে এক দৌড়ে ছুটিয়া যায়।
দরিয়াবিবির পাশে ভাইবোন শান্ত হইয়া বসে। অন্ধকার থমথম করে।
মা কোনো কথা বলে না, আমজাদ আরো ভয় পায়। ক্ষুণ্ণ স্বরে সে ডাকে, মা।
কী?
মার কোলে মাথা রাখিয়া সে উঠানে পা ছড়াইয়া দিল। প্রশ্ন করার কিছুই ছিল না, আমজাদ চুপ করিয়া থাকে।
উঠানে নিস্তব্ধতা।