একরাশ ধোঁয়া ছাড়িল আজহার খাঁ।
একদম ছোটলোক ইতরের পাড়া হয়ে যাচ্ছে। খাঁয়েদের নাম-ইজ্জত আর থাকবে না।
দরিয়াবিবি ঈষৎ ঠোঁট বাঁকায়। আজহার তা লক্ষ্য করে না।
আজহার বলিতে থাকে, হালফিল যারা পয়সাওয়ালা তাদের চালচলন আর বনেদি বংশের চালচলন দ্যাখো।
দরিয়াবিবি স্বামীকে আজ চটাইতে রাজি নয়। সে পাঁজ করিয়া তুলা একটি কুলোর উপর রাখিতেছিল।
থাকবে কী করে বংশের ইজ্জত, গরিব যে সবাই।
দরিয়াবিবি হঠাৎ যেন কথাটি খুঁড়িয়া ফেলিয়াছে এমন ভাব করে মুখের।
খালি পয়সা থাকলেই বংশের ইজ্জত থাকে না। মহেশডাঙার খাঁয়েদের নাম এখনও দশ-বিশ খানা গাঁয়ে পাওয়া যায়।
তা পাওয়া যায়।
দরিয়াবিবি সায় দিল।
কিন্তু পয়সা না থাকলে ইজ্জতও আস্তে আস্তে সরে পড়ে।
এবার চুপ করে আজহার খাঁ।
স্বামীর আচমকা নীরবতা দরিয়াবিবি পছন্দ করে না। কথার সূত্র সে অন্য টানা পড়েনের মধ্যে রাখে।
কাপড়-চোর আমার হাতেই ধরা পড়বে, দেখো।
কত কষ্টে কাপড় কেনা, আর চোর শয়তানেরা এমন দাগাবাজি করবে!
দরিয়াবিবি ডাকিল, আমু।
কী মা?
দেখো কাপড়চোপড় হারিয়ো না, বাবা।
না মা।
আমজাদ শিমুলতুলার ছিন্ন অংশ বাতাসে ফুঁ দিয়া উড়াইতেছিল।
না মা, আমার কাপড় হারায় না।
আসেকজান বেলাবেলি ঘরে ঢোকে। আজ তার ব্যতিক্রম হয় নাই। কানে সে কম শোনে। মাঝে মাঝে পরের কথা সে এমনভাবে বুঝিতে পারে, মনে হয় না সে বধির। অনেকের কাছে বুড়ি তাই সেয়ান-কালা নামে পরিচিত।
স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন তার কানে গিয়াছিল। ভরা সাঁঝে বিছানায় আশ্রয় লইলেও বুড়ির ঘুম হয় না। চোখ বুজিয়া রোমন্থনরত গাভীর মতো অতীত-জীবনের জট খোলে সে। ভোররাত্রির দিকে আসেকজান কয়েক দণ্ড ঘুমায় মাত্র।
হঠাৎ আসেকজান বাহিরে আসিল। দাওয়ার উপর খালাকে দেখিয়া আজহার জিজ্ঞাসা করিল, কী হল, খালা?
বৃদ্ধা খালার উপর আজহারের মমতা বেশি। শুধু একটা ঘর দখল করিয়া আছে, নচেৎ কী আর এমন খবরদারি করে সে। তারই সংসার অচল হইয়া পড়ে মাঝে মাঝে।
এই এলাম, বাবা। বলিয়া আসেকজান দাওয়ার উপর বসিয়া পড়িল।
তারপর কথা পাড়ে আসেকজান।
তোমাদের সংসার কী ছিল সাবেকি আমলে! না-হলে আমার এত কষ্ট! দরিয়া-বৌ তো সংসার চালাচ্ছে। লক্ষ্মী মেয়ে।
যার উদ্দেশ্যে প্রশংসা বর্ষিত হইতেছিল, সে একবার ভ্রুক্ষেপও করিল না।
তোমাদের কষ্ট আমি নিজের চোখে দেখছি।
দরিয়াবিবি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল এইবার। স্বামী-স্ত্রী সংসার লইয়া হাজার মন্তব্য করে। কিন্তু অপর কেউ সংসারের বেআব্রু এলাকা লইয়া আলোচনা করুক, দরিয়াবিবি তা আদৌ পছন্দ করে না।
আসেকজানের বক্তব্য শেষ হয় নাই। সে পুনরায় বলে, আজকাল দীন-ঈমানও ঠিক নেই। দীন-দুঃখীদের দিকে কেউ চায় না!
বৌমা।
দরিয়াবিবির জবাব সংক্ষিপ্ত : কী।
তোমার কাপড়ের টানাটানি। দুটো কাপড় পেয়েছিলাম।
আসেকজান তারপর আঁচল-ঢাকা দুটো কাপড় বাহির করিয়া বলিল, দুটো কাপড় তুমিই পর। আমার যা আছে চলে যাবে।
দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বর চাচাছোলা : কোথা থেকে পেলে শুনি?
ও পাড়ার ইজাদ চৌধুরীর মা ইন্তেকাল করেছিল, কাল মিসকিন খাওয়ালে আর কাপড় জাকাত দিলে।
জাকাত-জাকাত! দরিয়াবিবি হঠাৎ আগুন হইয়া উঠিয়াছে। দাঁত চাপিয়া সে আবার উচ্চারণ করিল, জাকাত!
জাকাত! আমি নেব জাকাতের কাপড়? আমার স্বামী বেঁচে নেই? ছেলে নেই? মুখে তোমার আটকাল না?
লাথি দিয়া একজোড়া কাপড় দরিয়াবিবি দাওয়ার নিচে ফেলিয়া দিল।
আজহার হঠাৎ ব্যাপারটা উপলব্ধি করিতে পারে না। কাপড় দুটো দাওয়ার নিচ হইতে সে কুড়াইয়া আনিল।
খবরদার! এমন কথা মুখে আনবে না। বের করে দেব আমার ঘর থেকে। তোমার জাকাতের মাথায় সাত পয়জার।
ধর্মভীরু আজহার খাঁ এমন কটুবাক্য পছন্দ করে না।
দরিয়া-বৌ, খেপে গেলে নাকি! এসব কী বকছ?
চুপ করো। যারা জাকাত নেয় তারা আর মানুষ থাকে না। জানোয়ার হইনি এখনও। আল্লা আমার হাত-পা দিয়েছে। মড়ার পেটের জন্যে হাত পাবে না কোনোদিন।
নিরীহ আজহারও বেশ চটিয়া যায়।
কাল থেকে তাহলে লাঙল ধরো মাঠে।
দরকার হলে তাও ধরব।
আজহার খাঁ চুপ করিয়া গেল। দরিয়াবিবি সমস্ত সংসার ঠিক রাখিয়াছে। অনিপুণ গৃহিণী ঘরে থাকিলে সে সংসার ছাড়িয়া দরবেশ হইয়া যাইত এতদিন।
তোমাকে ভালো মুখে বলছি, খালা এসব কথা কোনোদিন মুখে এনো না। আমরাও গরিব। দুমুঠো যা-হোক করে চলে যাচ্ছে।
তোমার দরকার নেই? জানো না, তোমার জাকাতের চাল আমরা পয়সা দিয়ে– কিনে নিই!
আসেকজান স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে পাষাণমূর্তির মতো। ধূলা-লাগা কাপড় দুটো বুকে করিয়া সে কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল, তারপর সন্তর্পণে ঘরে ঢুকিয়া পড়িল।
আমজাদের হাই উঠিতেছিল। সে ঘুমাইতে চায়।
হাতের তুলায় দ্রুত পাঁজ দিয়া দরিয়াবিবি বলিল, ও ঘরে শুতে যাসনি। আমার কাছে শো।
আমজাদ আর পা বাড়াইল না। আজহার খাঁ চুপচাপ বসিয়া রহিল। অকস্মাৎ দমকা ঝড় বহিয়া গিয়াছে যেন দাওয়ার উপর।
মাঝরাত্রে দরিয়াবিবির ঘুম ভাঙিয়াছিল। তার পাশে আমজাদ নাই। শয্যা শূন্য। কোথায় গেল আমজাদ?
ডিপা জ্বালিয়া সে আসেকজানের ঘরে অতি সন্তর্পণে প্রবেশ করিল। আমজাদ তার পরিচিত জায়গায় মাদুরের উপর অঘোরে ঘুমাইতেছে। আর আসেকজান উবু হইয়া বসিয়া গিয়াছে। হাঁটুর উপরে অবনত মুখ। শণের মতো শাদা চুল সম্মুখে-পেছনে লুটাইয়া পড়িয়াছে। ফোঁপানির শব্দ উঠিল। কাঁদিতেছে বৃদ্ধা আসেকজান? দরিয়াবিবি সেই দিকে চাহিয়া রহিল। দারিদ্র্যের নারী-প্রতীক যেন ওই গৃহকোণে আশ্রয় লইয়াছে। আল্লার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবন। এই তার পরিণতি! দরিয়াবিবি অসোয়াস্তি অনুভব করে। দারিদ্র্যের দাবানলে সংগ্রাম-বিক্ষুব্ধ জীবনের সমগ্র ঐশ্বর্যসম্পদ ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে। লোলচর্ম কোটরাগত চক্ষু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মানুষের আত্মার দিকে চাহিয়া আছে মাংসলোভী কুকুরের মতো।