খড়ো দহলিজ। একপাশে মাচাঙে বর্ষার সময় খড় তুলিয়া রাখা হয়। লাঙল, কোদাল, চাষের যন্ত্রপাতি থাকে এককোণে। কোনো মেহমান আসিলে বাকি দুই কোণ দখল করে।
আজহার খাঁ লাঙল কোণে দাঁড় করাইয়া ফিরিতেছে। তাহার মনে হইল কে যেন দহলিজের কোণ হইতে পূর্বদিকে চলিয়া গেল একদম দাওয়ার পাশে।
কে গো!
কোনো জবাব আসে না, ছায়ামূর্তি অনড় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
কে গো!
আমজাদ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়াছিল, ভয় পায় সে। জ্বি আসিয়াছে দহলিজে! মার কাছে জ্বিনের গল্প শুনিয়াছে সে। দহলিজে কোরান শরীফ আছে একখানি। রাত্রে তাহারা নাকি কোরান মজিদ পড়িতে আসে।
আজহার খাঁ ছেলেদের নিকট এই গল্প করিলে খুব চটিয়া যায়। তারও মনে খটকা লাগিয়াছিল।
জোরেই হাঁকিল সে, কে গো?
দাওয়া হইতে সে প্রাঙ্গণে লাফাইয়া পড়িল পাঁচন-বাড়ি হাতে।
ছায়ামূর্তি এবার ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে।
আজহার আমজাদকে ডাকে, এখানে আয়, আমু।
কে গো?
উলঙ্গ একটা ছোট মেয়ে। আবছা আলোয় আজহার চিনিল, তারই মেয়ে নঈমা।
নমু, তুই এখানে?
কোনো জবাব দিল না সে। তার ফোঁপানি কান্না বাড়িয়া যায়।
এত রাত্রে তুই এখানে?
আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথা?
দহলিজে আজহার খাঁ শোরগোল তোলে। অন্দর হইতে বাহির হইয়া আসিল দরিয়াবিবি।
এত গোলমাল কিসের?
আজহার খাঁ স্ত্রীর সম্মুখীন হইয়া বলে, দুধের মেয়েটা এই রাত্রে অন্ধকারে-কোনো খোঁজ রাখা দরকার মনে করো না?
খুব দরকার। মনে করেছে।
দরিয়াবিবি এবার নঈমার দিকে চড় তুলিয়া অগ্রসর হয়।
দাঁড়া হারামজাদী।
তিন বছরের মেয়ের মুখে রা নেই। কলহোন্মুখ স্ত্রীর সম্মুখে দাঁড়াইল আজহার খাঁ।
কী হয়েছে, খুলেই বল না।
এতবড় ধাড়ি মেয়ে, ফালি-কাপড়টা হারিয়ে এল।
আজহার জিজ্ঞাসা করে, কোন্ ফালি-কাপড়টা?
সেদিন যেটা গঞ্জ থেকে কিনে আনলে।
ইশ! আজহার অস্ফুট শব্দ করে।
আর এমন হাবার ঘরের হাবা, কী করে হারাল বলতে পারে না।
আজহার কথা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
তার জন্যে খুব মার মেরেছ বুঝি?
দরিয়াবিবি ঝঙ্কার তোলে : আমি জানি, আমার হাত জানে আর জানে ওর পিঠ।
আজহার নঈমাকে কাছে টানিয়া পিঠের উপর হাত বুলাইতে লাগিল।
করেছ কী? এত দাগ!
মারবে না। সংসার নিয়ে আমি বুঝি অভাবের তাড়না। আর ওরা সুদ্ধ আমাকে জ্বালাবে।
আজহার খাঁর রাগ বাড়ে প্রতিবেশীদের উপর।
এমন চোরের পাড়া। হয়ত ছোটমেয়ে সব সময় কাপড় পরে না। কোথাও ফেলেছিল, ব্যাস আর কী চোর তো সব।
দরিয়াবিবি যোগ দিল : সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কারো মুখে না ছাড়া হা শব্দ নেই।
যাক, আর উপায় কী। নঈমাকে কোলে নাও।
আজহার বাথানে বাঁধিয়া বলদ দুটিকে কয়েক আঁটি খড় দিল।
নঈমা পিতার সঙ্গ ছাড়ে না। দরিয়াবিবি তাকে কোলে তুলিয়া লওয়া মাত্র সে ফেঁপাইয়া কান্না জুড়িল। মা মেয়ের মুখে চুম্বন করিয়া বলিল, কে ফালিটা নিল, মা?
নঈমা কাঁদে শুধু।
ঘরে চলো। আর দাঁড়িয়ে লাভ কী। আমি মুখ-হাত ধুয়ে আসি।
আমজাদ তরমুজ হাতে মার সঙ্গে চলে। এতক্ষণ সে কারো চোখে পড়ে নাই, বড় দুঃখ তার। গর্বের আনন্দ মাঝমাঠে মারা গেল।
ঘরে ঢুকিয়া আমজাদ মার সম্মুখে তরমুজ রাখিয়া নিতান্ত অপরাধীর মতো ধীরে ধীরে বলিল, মা তরমুজ।
দরিয়াবিবির চোখেমুখে হাসির ঝিলিক খেলিয়া যায়।
আরে আমু-চাচা, কে দিল রে এতবড় তরমুজ?
উই মাঠের চন্দ্ৰকাকা।
বেশ পাকা তরমুজ তো। দরিয়াবিবি আমজাদের দিকে চাহিয়া হাসে।
এতক্ষণে ভালো লাগে আমজাদের সবকিছু।
দরিয়াবিবি নঈমাকে বলিল, ঐ দ্যাখ, কাল তরমুজ খাবি। কয়েকটি টোকা মারিল দরিয়াবিবি তরমুজের উপর।
খুব খারাপ নয়, বাবা। দুদিন ঘরে রাখতে হবে।
নঈমার মুখেও হাসি ফোটে।
মা, আমি খা-আ-বো।
হ্যাঁ, তুমিও খাবে।
পা মেলিয়া দরিয়াবিবি মাদুরের উপর বসিয়া আমজাদকে সে তারই পাশে উপবেশন করিতে বলিল। আমজাদ মাঠের কাহিনী বর্ণনা করে মার নিকট।
কিন্তু মাঠে এত দেরি ভালো নয়। তোমার পড়া হল না কিছুই। আজ একটু পড়ে নাও।
দরিয়াবিবি মাটির ডিপা আর করঞ্জ তেল আনিল। কেরোসিন সবসময় কেনার পয়সা থাকে না। দরিয়াবিবি খুব ভোরে উঠিয়া করঞ্জ ফল কুড়াইয়া আনে। তাই কলুর ঘানি হইতে তেল হইয়া ফেরে।
পড়ে নাও, বাবা। তোরা সকালে যাস্ খেজুর পাড়তে, বকুল কুড়াতে। চাট্টি করঞ্জা কুড়িয়ে আনতে পারিস না?
নঈমা বহু লাঞ্ছনা সহ্য করিয়াছে, ঘুমাইয়া পড়িয়াছে সে।
আজ মার খেয়ে পেট ভরল। আর রাত্রে খাবে, ওর যা ঘুম।
আমজাদের ভালো লাগে না এত রাত্রে পড়া। মার সামনে কোনো অভিযোগ চলে না। টিমটিম ডিপার আলোয় সে পড়িতে বসিল। দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজে উঠিয়া গেল।
পাড়ার আরো কয়েকজনের কাপড় চুরি গিয়াছিল। কেবল ছেলেদের কাপড় চুরি যায়। দরিয়াবিবির বড় লাগিয়াছে আজ। মাত্র বারো গণ্ডার পয়সার জিনিস। তার বহু। পরিশ্রমের ফল, উপলব্ধি করে সে।
দরিয়াবিবি সহজে দাগটা মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না।
নৈশভোজনের পর আজহার গুড়ুক খুঁকিতেছিল দাওয়ায় বসিয়া।
আমজাদ একপাশে নিজের কল্পনা লইয়া ব্যস্ত। শিমুলতুলার দানা বাছাই করে দরিয়াবিবি।
দ্যাখো, এমন সব চোর, খালি ছেলেদের কাপড় চুরি করবে।
আর কার কাপড় চুরি হয়েছে?
প্রশ্নকর্তা আজহার।
মতির ছেলের ধুতি, সাকেরের মেয়ের ছোট শাড়ি, আরো অনেকের।