আমজাদ দোকানে এক পয়সার লজেস কি কড়ি-বিস্কুট কিনিতে আসে। গেরস্থালির সওদা কোনোদিন করে না। প্রথমদিনের কর্তব্য বোঝা ঠেকে তার কাছে।
যা।
মোলায়েম নয় কণ্ঠস্বর আজহার খাঁর। যার যেমন পয়সা তেমন কেনে, লজ্জা কিসের?
পিতার শেষ বাক্য আমজাদের কানে প্রবেশপথ পায় না, সে দোকানের দিকে অগ্রসর হইল।
বলদ দুটি সম্মুখে। লেজ দোলাইয়া মশা তাড়াইতেছে। আজহার খাঁ আর একবার হাঁকিল, হাউ।
ফিরিয়া আসিল আমজাদ। কাঁচুমাচু মুখ।
আব্বা, দেশলাই ফুরিয়ে গেছে। মোটে দশটা কাঠি আছে। আর সিকি পয়সার নুন দেবে, দোকানি বললে।
যা, তাই নিয়ে আয়।
এইখানে কাঠা-দুই ফাঁকা খামার। চারপাশে পাড়ার গাছপালা। বাতাস আসে না বেশি। আজহার খাঁ প্রতীক্ষা করে।
এই নাও, আব্বা।
আজহার খাঁ কাঠি গনিয়া দেখিল। নুনের প্যাকেট, দেশলাই, বিড়ি গামছার খুঁটে বাঁধিয়া বলিল, চল বাবা।
তরমুজ যেন ভারী হইয়াছে দশগুণ। আমজাদের মনে বিস্বাদ জমিয়া উঠে। মাঠে বিচরণের আনন্দ উবিয়া গিয়াছে তার। পিতার দিকে চাহিয়া তার নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। দুটি বলদের সঙ্গে আর একটি পশু যেন হাঁটিতেছে লাঙল কাঁধে। ঘৃণার সর্পিণীরা ক্রুদ্ধশ্বাস ফেলিতেছে কচি বুকের ভেতরে।
মুখ ভার করিয়া পিতার পেছনে পেছনে চলে আমজাদ।
খাঁয়েদের সড়ক আরো সংকীর্ণ। দুপাশে বেত আর হেলঞ্চ-ঝোঁপ ঘন। চাঁদের আলো গাছের ফাঁক দিয়া সন্তর্পণে মাটির উপর নামে। ভালোরূপে সড়ক দেখা যায় না। লাঙলের ফলক পাছে লতায় জড়াইয়া যায়, আজহার খাঁ পদক্ষেপ তাই আরো মুথ করে।
বাবা, আমু, আমার ঠিক পেছনে আয়।
আমজাদ বাবার কণ্ঠস্বর চেনে। আশঙ্কা স্নেহ-বাৎসল্য রসের প্রস্রবণরূপে জোছনার মতোই ঝরিতেছে যেন।
আমজাদ ভয় পায়। পিতার নিকটে আসিয়া সে সোয়াস্তি অনুভব করে। বুক হাল্কা হইয়া যায়।
আমু।
আব্বা।
রাগ করেছিস আমার উপর?
আমজাদ হঠাৎ জবাব দিতে পারে না। পিতা কি তার মনের গতিবিধি বোঝে?
না, আব্বা।
লাঙলের ফলা হেলঞ্চ-লতায় জড়াইয়া গিয়াছিল। আজহারকে দাঁড়াইতে হয়।
এক হাতে লতাটা সরিয়ে দাও, বাবা।
আমজাদ অতিকষ্টে লতা-মুক্ত করিল ফলাটি। আরো সাবধানে পা ফেলে আজহার।
কুঞ্চিত চাঁদের মুখ। বনরাজ্যে ভেদ করিয়া স্পষ্ট আলো এদিকে আসে না।
আজহার খাঁ বলে, গরিব বলে মন খারাপ করতে নেই। সব আল্লার ইচ্ছা। না হলে খোদা নারাজ হন।
আমজাদ কোনো জবাব দিল না। সে শুধু শোনে।
ঝিল্লিস্বর বিজন গ্রাম-ভূমির উপর প্রহর-কীর্তন করিতেছে। বড় বকুলগাছে চাঁদের আলোয় হনুমান-দল এখনও জাগিয়া রহিয়াছে। ছানাগুলোর কিচকিচ শব্দ শোনা যায়। লাফালাফির হট্টরোল উঠে বকুল-ডালে।
এই পথে একা-একা চলা আমজাদের সাহসে কুলায় না। পীরের মাজার রহিয়াছে। বকুলতলায়। গাঁয়ের লোকেরা প্রতি জুম্মার রাত্রে মানত শোধ করিয়া যায়। আজদাহা সাপের পিঠে আরোহণ করিয়া দরবেশ সাহেব গভীর রাত্রে গ্রাম-ভ্রমণে বাহির হন। বড় মেহেরবান পরলোকগত এই দরবেশ, শাহ্ কেরমান খোরাসানী। সকলের দুঃখের পশরা তিনি একাকী বহিয়া বেড়ান। সামান্য অসুখ-বিসুখে পীরের মাজার একমাত্র আশ্রয়।
কুড়িহাত বেড় মোটা বকুলের গুঁড়ির দিকে চোখ পলক মাত্র নিবদ্ধ করার সাহস হইল না আমজাদের।
গুঁড়ির উপরে মোটা দুটি ডাল। তার মাঝখানে একটি বিরাট গহ্বর। আজদাহা সাপ এইখানে বাস করে। মাঝে মাঝে দিনে বাহির হয়। কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।
কিংবদন্তির অন্ত নাই। কত কাহিনী না দরিয়াবিবির কাছে আমজাদ শুনিয়াছে। গা। ছমছম করে তার।
জাগ্রত দরবেশ। গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সকলেই মানত করে এই মাজারে।
টুপটাপ পাকা বকুলফুল পড়িতেছে। আমজাদ এই শব্দ চেনে। কাল খুব ভোরে বকুল কুড়াইতে আসিবে সে।
পড়ো ভিটে সম্মুখে। বর্ষাস্নাত ঘরের দেওয়াল এখনও খাড়া রহিয়াছে। আলো অন্ধকারে বিজন, বেত আর বনতুলসীর ঝোপে ভয়াবহ, প্রতিবেশীদের আভাসভূমি মহাকালের প্রতীক্ষা করিতেছে।
আর সামান্য পথ। এই সড়কটুকু শেষ হইলে দহলিজে পৌঁছাইবার রাস্তা।
আমজাদের মন আনন্দে নাচিয়া উঠে। শাদা-কালো রেখাসমন্বিত তরমুজের দিকে সে বারবার চায়। মা আজ খুব খুশি হইবেন। গুমোট মনের আবহাওয়া এতক্ষণে কাটিয়া যায়।
নবমীর চাঁদ পশ্চিম গগনের সিঁড়ি বাহিয়া ধীরে ধীরে দিক মেঘলার দিকে অবতরণ করিতেছে। আকাশের এই কোণটা শাদা মেঘের আলিঙ্গনে দিঘির মতো মনে হয়।
দহলিজের সড়কে আসিয়া আমজাদ আর পিতার পেছনে পড়িয়া থাকে না। পাশ কাটাইয়া অগ্রবর্তী হইল সে। এইসব জায়গা তার মুখস্থ। বন-জুয়ানের ছোট তরুলতা কোথায় ফুটিয়া আছে, তাও সে চোখ বুঝিয়া বলিতে পারে।
দহলিজের প্রাঙ্গণে আসিয়া আমজাদের ভয় লাগে। একটা ছায়ামূর্তি যেন সরিয়া গেল তার সম্মুখ হইতে।
বাবার কাছে কোনো আভাস দিল না সে। একবার মাত্র থমকিয়া দাঁড়াইল। আবার পশ্চাদ্বর্তী আমজাদ।
আজহার খাঁর দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। পুত্রের গতিবিধি সে লক্ষ্য করে নাই।
একটু দাঁড়া, আমু। লাঙল আর বলদ দুটো নিয়ে যা দেখি।
আমজাদ তরমুজ দহলিজের দাওয়ায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাখিল। বাবাকে ভয় করে সে। নচেৎ ঘরে ঢুকিয়া মাকে অবাক করিয়া দেওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে। এমন সুন্দর বড় তরমুজ কে কবে আনিয়াছে এই সংসারে?