গরিব চাচা, ঘরে কিছু নেই আমু। মার কাছে বদনাম করো না।
চন্দ্ৰকাকা হাসে আর কথা বলে। চোখ পিটপাট করিয়া পা নাচাইতেছিল সে। লাজুক আমজাদ মাথা নিচু করিয়া মুড়ি ঠোঁটে তুলিতেছিল।
খাঁয়েদের বাড়ির ছেলে না?
এলোকেশীর জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ। আমার বাড়িরই ছেলে বলতে দোষ কী?
দোষ আর কী!
এই বংশের কত গল্প যে শুনেছি ঠাকুরমার কাছে। কী হল কলিকালে।
আমজাদ এলোকেশীর চোখের দিকে চায়। পাছে ধরা পড়ে, দৃষ্টি নামিয়া আসে সেইজন্য।
আর নূতন খাঁয়েদের কাহিনী শোন নি?
মহেশডাঙা বর্তমানে দুই জমিদারের অধীন। ছআনি আর দশ আনি জমিদার। ছয় আনার মালিক হাতেম বখ্শ খাঁ। দশ-আনির অধিকারী রোহিনী চৌধুরী। মালিকেরা সংখ্যায় তিন-চারিটি পরিবার। একটি নূতন পাড়ার পত্তন করিয়াছে ইহারা। গ্রামের লোকের কাছে তারা নুতন-খা নামে বিদিত।
আরে দূর ছাই। কিসে আর কিসে। রহিম খায়ের বাবাকে কে না জানত? সুদখোর। সুদের পয়সায় জমিদার-।
চন্দ্র কোটাল বাধা দিয়াছিল এই সময় : তোমরা জানো না, গরুর গায়ে ঘা হলে নটা সুদখোরের নাম লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিতে হয়। পোকা পড়ে যায়। আগে পেরতম নাম লিখত জায়েদ খার–রহিমের বাবার। তোমাদের গরু কটা ঠিক আছে তো চাচা?
সংলাপের গুঞ্জন ওঠে আমজাদের চারপাশে। চন্দ্ৰকাকার হাসির মাদকতা বাতাসে ভাসিয়া আসে।
আজকের পথ-চলা বড় আনন্দদায়ক। থাক তরমুজের বোঝ। তবু। বড় তরমুজ আমজাদের পক্ষে বোঝা বিশেষ। বারবার ফেরি করিতেছিল সে। পিতার পদক্ষেপ দ্রুত নয়, এইটুকু যা সুবিধা।
আমজাদ শেষে মাথায় তুলিল তরমুজটি।
একফালি মেঘ পাতলা আবরণে হঠাৎ চাঁদের মুখ ঢাকিয়া দিল। প্রান্তরের উপর ঈষৎ স্লানিমা। মাকড়া অন্ধকার জমিয়া ওঠে সড়কের উপর।
আজহার খাঁ আজ খুব ক্লান্ত। চন্দ্র কোটাল আমজাদকে সন্ধ্যার আগে পৌঁছাইয়া দেয় নাই। অপেক্ষা করিয়াছিল কিছুক্ষণ আজহার খাঁ। খামাখা বসিয়া থাকা আর তামাক ধ্বংস করা তার ধাতে পোষায় না। তাই সে আবার কাজে লাগিয়াছিল। জমির টুকিটাকি কাজে অনেকক্ষণ কাটিয়াছে। তারপর আসিল চন্দ্র আর আমজাদ। সুতরাং আরো বিলম্ব হইয়াছিল। চন্দ্র কোটাল কত কথাই না বলে। নেশা কাটিয়া গিয়াছে তার। সুখ-দুঃখের কথায় রাত্রি বাড়ে। জোছনা রাত্রি, আজহার খাঁর কোনো তাড়া ছিল না। চন্দ্র আজ আর বাড়ি ফিরিবে না। তরমুজ ক্ষেত পাহারায় তার রাত্রি কাবার হইয়া যাইবে।
ছেলেটাকে আবার মাঠে এনো, আজহার ভাই।
শিস দিতে দিতে মাঠে নামিয়াছিল চন্দ্র। তার অপরূপ চলার দুলকি ভঙ্গি আমজাদের সামনে স্পষ্ট। পিতার উপর আবদারের জোরটা এবার বিফলে যাইবে না, কোটাল কাকার মতো মুরব্বি রহিয়াছে যখন।
আবার চাঁদের মুখ দেখা যায়। মেঘেদের নেকাব খুলিয়া গিয়াছে। সড়কের উপর উজ্জ্বল দিনের আলো ঝরে যেন। আমজাদ গ্রামের প্রবেশপথে একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল। দিগন্তের মেঘলা আলো অন্ধকার প্রান্তরের বিবাগী সীমানা আঁকিয়া দিতেছে। রবিফসলের ক্ষেতের উপর বহু বাঁশ-ডগালির ছায়ারেখা উঁচানো। পেচকের দল ঘুরিয়া ঘুরিয়া তার উপর বসিতেছে। জোছনার আলোয় মেঠো ইঁদুর-শিকার দেখা যাইত। আর একটা কৌতূহলের উঁকি আমজাদের মনে। দিনের আলোয় অন্ধ পেঁচা ইঁদুরের মতো চতুর প্রাণী শিকার করিতে পারে, তার বিশ্বাস হয় না। চন্দ্ৰকাকার কাছে সঠিক সংবাদ পাওয়া যাইবে।
অবোধ বালকের পশ্চাতে প্রান্তরের ইশারা মাথা কুটিতে থাকে। গ্রামের সরু সড়ক। আশেপাশে প্রতিবেশীদের ঘর। জনপদের জীবনে এখনও কোলাহল থামে নাই। প্রথমেই পড়ে নূতন খাঁয়েদের পাকা দহলিজ। ছেলেরা হল্লা করিয়া পড়িতেছে। জমিদারি সেরেস্তার কারখানায় নায়েব পাইকেরা কোন মন্ত্রণায় মাতিয়াছে। মহবুব মৃধার মুদিখানায় এখনও খরিদ্দার আছে। টিমটিম আলো জ্বলিতেছে। মহবুব বসিয়া আছে একটা চৌকির উপর দাঁড়িপাল্লা হাতে। সন্ধ্যার পর গ্রামের চাষী-মজুরদের সওদা আরম্ভ হয়। এক পয়সার তেল, আধ পয়সার লঙ্কা, সিকি পয়সার নুন। ছোট মুদিখানা, তার খরিদ্দারগণের চাহিদাও অল্প। দিনের বেলা ফুরসৎ থাকে না কারো। অবেলা সন্ধ্যায় সওদা শুরু হয়। মহবুবের মুদিখানায় এখনও আলো জ্বলিতেছে, তা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
আজহার খাঁ লাঙল মাটির উপর নামাইয়া রাখিল।
ঝিরঝির বাতাস দিতেছিল। সে মাটির উপর বসিয়া গামছা দোলাইতে লাগিল। আজহার খাঁ রীতিমতো ঘামিতেছে।
হাউ।
বলদ দুটি অগ্রসর হইতেছিল। আজহার খাঁর ডাকে থমকিয়া দাঁড়াইল।
বাবা আমু, তরমুজটা রাখ। একবার দোকানে যা।
আমজাদ পিতার আদেশমতো তরমুজ সাবধানে মাটির উপর রাখিল, হাত ফসকাইলে চৌচির হইয়া যাইবে।
এই নে বাবা, দুটো পয়সা। আমি একটু জিরোই। লাঙলটা দিনদিন ভারী হয়ে যাচ্ছে।
কী আনব, আব্বা।
দুটো পয়সা। দেড় পয়সার বিড়ি আর আধ-পয়সার দেশলাই।
তারপর একটি খালি দেশলাইয়ের খোল আজহার লুঙির ট্র্যাক হইতে বাহির করিল।
এই নে খোলটা। গোটা কুড়ি কাঠি দেবে। গুনে নিস্, বাবা। পয়সা হাতে লইয়া আমজাদ ইতস্তত করে।
দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
আমি যাব না আব্বা।
কেন?
আধ- পয়সার দেশলাই, লজ্জা লাগে।
হঠাৎ ক্লান্তিজনিত বিরক্তি বোধ করে আজহার খাঁ।
এইজন্য মনে করি আর মখতবে পাঠাব না তোকে। গরিবের ছেলে বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশে মেজাজ এমনি হয়ে যায়।