ঝিঙে-বাড়ির চারপাশে চাষীরা বাবলা কাঁটা দিয়াছে। ইতঃক্ষিপ্ত কাঁটারও অভাব নাই। আমজাদ চন্দ্র কোটালের পেছনে সন্তর্পণে হাঁটিতেছিল। চন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইল।
দাঁড়াও, আমু।
দুইজনের মধ্যে একফালি জমির ব্যবধান। এখানে তামাকে ক্ষেত খুব ঘন। আমজাদ চন্দ্র কাকার সমগ্র অবয়ব দেখিতে পায় না। কোটালের কথামতো সে থামিয়া দাঁড়াইল।। আমজাদের কানে যায়, চন্দ্র বলিতেছে : জমিটা হারান মাইতির, তাই এত কাটা, যেমনি প্যাচালের লোক। দূর করে দিতে ইচ্ছা করে।
এক মুহূর্তে চন্দ্রকে আমজাদের পাশে দেখা গেল।
বেশ করেছ। তোমাকে আর হাঁটতে হবে না।
আমজাদকে আর কোনো কথা বলিতে দিল না চন্দ্র, তাকে কাঁধে তুলিয়া লইল সটান।
আমজাদ প্রথমে অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল, এখন ভালো লাগে তার। চন্দ্ৰকাকাকে ভয় নাই কিছু। কাঁধে চড়িয়া দূরের গ্রাম আর কিষাণপল্লী অপরূপ দেখায়।
ক্ষেত পার হইবার পর বুনোঘাসের পথ। ফড়িং উড়িতেছে চারিদিকে। চন্দ্র আনমনে চলে। নির্বিকার, নিঃশঙ্ক। শিসের জোয়ার আসে আবার।
আমার মাথাটা আঁকড়ে ধরিস, বাবা! পড়বার ভয় করো না।
ইহার পর কল্পিত একটা বাঁশি দুই হাতে ধরিয়া চন্দ্র শিস দিতে লাগিল। আমজাদের ভয় লাগে। টাল সামলানো দায় তার পক্ষে।
দম ভরিয়া শিস দেয় চন্দ্র। বোধহয় গান মনে ছিল না, তাই মেঠো সঙ্গীতের রেশ ওঠে না কোথাও।
আমজাদ নিচের দিকে চাহিয়া দেখে, বুনোঘাসের সীমানা আর শেষ হয় না। তার প্রতি চন্দ্ৰকাকার অনুকম্পার কারণ এখন বুঝিতে পারে।
আমজাদ তাদের জমির দিকে চাহিয়া দেখিল, আব্বা আর চোখে পড়ে না। কতগুলি তালগাছের আড়াল হইয়া গিয়াছে সব। ক্ষীয়মাণ সূর্যরশ্মি চিকচিক করিতেছে তালের পাতায়।
চন্দ্রের শিস এইমাত্র থামে।
চাচা, কাঁধে চড়ে কষ্ট হচ্ছে না তো?
না।
সংক্ষিপ্ত জবাব আমজাদের।
চন্দ্র আবার কল্পিত বাঁশি ঠোঁটে রাখিয়া আঙুল নাচাইতে নাচাইতে হঠাৎ থামিল।
ঠিক চাচা, কাঁধে ভালোই লাগে। দুনিয়ার রংই ফিরে যায়। জমিদার সেজে বসে থাকো, চাচা।
আমজাদ চন্দ্ৰকাকার হেঁয়ালি বুঝিতে পারে না। উঁচু-নিচু মাটির উপর পা ফেলিতেছে কোটাল। তাই তার ঝাঁকড়া চুল আরো কষিয়া ধরে আমজাদ।
ঐ যে আমার কুঁড়ে দেখা যায়।
চকিতে চোখ ফিরাইল আমজাদ। দুই ছোট নদীর মোহনা। নদী নয়, একটু বড় খাল। আরো কয়েকটা কুঁড়ে পাশাপাশি। সম্মুখে বড় বালির চাতাল। উঁচু ঢিবির উপর ঘরগুলি। সম্মুখে যোজন-যোজন অভিসারযাত্রী প্রান্তর। ওয়েসিসের মতো চোখে পড়ে মাটির সন্তানদের আবাসভূমি।
আমজাদের কৌতূহল বাড়ে। চাতালের উপর কতগুলি ছেলেমেয়ে হল্লা করিতেছে, কয়েকজন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ঢিবির উপরে। চন্দ্ৰকাকা শিস দিতে আরম্ভ করিয়াছে। ছেলেদের ভেতর কলরব আরো বাড়িয়া যায়।
শাদা চত্বরের নিকট আসিয়া চন্দ্র জোরগলায় ডাক দিল, এলোকেশী-এলোকেশী!!
ছেলেদের মাঝখানে চন্দ্র কোটাল। ঝটকা স্তব্ধতা আসে একবার। চন্দ্র হাঁকে, এলোকেশী!
ভিড়ের ভেতর হইতে একটা ছেলে বলিল : চন্দ্ৰকাকা আজ আবার মাতাল হয়ে এসেছে।
ঢিবির উপর হইতে একটি মাঝবয়সী মেয়ে বাহির হইল। চাষীগেরস্থ ঘরের মেয়ে। ঈষৎ স্থূল-তনু। রোগ-শোক-দীর্ণ মুখ। পরনে ময়লা ন-হাতি কাপড়।
চন্দ্র এইবার সঙ্গীত পরিবেশন করে। ক্রীড়ারত শিশুদের মধ্যে স্তব্ধতা আরো বাড়িয়া যায়। কয়েকজন মুচকি হাসে।
এলোকেশী চন্দ্রের স্ত্রী। নিচে নামিয়া আসিল।
কাঁধে কার ছেলে গো?
আমার। যাও যাও শিগগির। মুড়ি-টুড়ি আছে?
আমজাদের পা ও ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়া ছোট শিশু দোলানোর মতো চন্দ্র এক ভঙ্গি করিল। একটি শিস, সুইৎ শব্দে থামার সঙ্গে সঙ্গে মাটির উপর বসিয়া পড়িল আমজাদ। ভিড় জমে চারপাশে। নদীর ওপারের ছেলেরা এইখানে খেলা জমায় প্রতিদিন। জোয়ারে হাঁটুজল হয় না, তাই পারাপারের কোনো অসুবিধা নাই।
খোকা, এসো আমার কাছে।
এলোকেশী দুই হাত বাড়াইল।
.
০৩.
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছিল নবমীর।
আমজাদ পিতার অনুসরণ করে। বলদ দুটি তারও আগে। লাঙলের আবছায়া পড়ে মাটির উপর।
পৃথিবী ক্রমশ বিস্তীর্ণ হইতেছে। মাঠে গ্রামছাড়া হতভাগ্য বহু মানুষ বাস করে; কিন্তু তারা এমন মানুষ, আমজাদ কোনোদিন জানিত না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মা তাকে মিশিতে দেয় না। রাখাল ছেলেরা অনেক দূর মাঠে মাঠে গোচারণে যায়। আমজাদের সে সৌভাগ্য হয় না। অবাধ শিশুমনের অপূর্ব পুলকের সাড়া পড়ে। চাঁদের আলো আরো উজ্জ্বল হইতেছে। দিগন্তে ঝাঁপসা বনানীর রেখা, রবি-ফসলের প্রান্তর স্বপ্নের বার্তা বহিয়া আনে। কিসের স্বপ্ন? আমজাদ হদিশ করতে পারে না। মার উপর হঠাৎ বিক্ষোভ জাগে তার। পাড়ার ছেলেরা বদ, তাদের সহ্বৎ (সংসর্গ)) ভালো নয়, তাই দূরে-দূরে থাকিতে হয় তাকে। মখতবের পর মার কাছে হাজিরি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
আমজাদের মনে পড়িল এলোকেশীর কথা, চন্দ্ৰকাকার কথা। আরেক জগতের মানুষ তারা। তাদের ঘর-দোর, খাওয়া-পরা, চাল-চলন অনেকখানি সে দেখিয়া আসিয়াছে অল্প সময়ের মধ্যে।
এলোকেশী মুখ ভার করিয়া বলিয়াছিল, খোকা, এমন অদিনে এলে! ঘরে মুড়ি ছাড়া আর কী আছে, বাবা!
আমজাদ মুড়ি খাইতেছিল। চন্দ্ৰকাকার মেয়ে ধীরা সম্মুখে দাওয়ায় দাঁড়াইয়া তার খাওয়া দেখিতেছিল। ধীরার চোখে দুনিয়ার বিস্ময়।