অমন হাঁকছিলে খামাখা। তোমার ক্ষেতে তো লোক নেই।
রাত্রেও মাঝে মাঝে হাঁকতে হয়। লোক নেই, চোর জুটতে কতক্ষণ।
হুঁকার মাথা হইতে কল্কে লইয়া চন্দ্র এলোপাথাড়ি টান আরম্ভ করিল।
তুমি তরমুজটা কেটে দাও ছেলেকে।
আমজাদ বিছানো খড়ের উপর বসিয়াছিল। তার পাশে বসিল চন্দ্র। ভকভক গন্ধ বাহির হয় মুখ হইতে। আমজাদ অসোয়াস্তি বোধ করে। একটু সরিয়া বসে।
চন্দ্র বলে, ভয় পেয়েছ বাবা?
না।
আজহার অভয় প্রদান করে।
ভয় কী। তোর চন্দর কাকা, আমু।
আমু চাচা, শুরু করো।
আজহার তরমুজ কাটিয়া দিল। লাল-দানা শাদা শাঁসের ভিতর দিয়ে উঁকি মারে। তরমুজ খুব পাকা।
তুমি একটু নাও, চন্দর।
না, না। আমি একটু রসটস গিলেছি। আর না। চন্দ্র ধোঁয়া ছাড়ে।
আমু চাচা, খেতে পারবে সব?
পারব, চন্দ্র কাকা।
বেশ কথা বলতে পারে তো।
চন্দ্র আমজাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
বড় কষ্ট হয় আজের-ভাই। বড় মায়া দেয় মুখগুলো। কিন্তু খামখা।
আজহার কোটালের কথা সম্পূর্ণ বুঝিতে পারে না। বলে, কী বলছ?
এই ছেলেপুলের কথা। বড় মায়া দেয়। কিন্তু সারাজীবন তো খেটেখেটে বিনি আহার বিনি-কাপড়ে যাবে আমাদের মতো। চাষীর ছেলে!
কেন?
এখনও বুঝলে না, অজের-ভাই! মানুষ করা সাধ্যিতে কুলাবে?
কথাটা আজহারের মনঃপূত হয় না। পুত্রের জীবন সম্বন্ধে সে এত নৈরাশ্য পোষণ করে না।
খোদা নসিবে লিখে থাকলে মানুষ হবে!
ফের কপালের কথা তুলেছ। এই দ্যাখো, আমার সঙ্গে পাঠশালে সেই যে হরি চক্কোত্তির ছেলেটা ছিল, একদম হাবা, কত কান মলে দিয়েছি, মানসাঙ্ক পারত না, সেটা হাকিম হয়েছে। গায়ে তোর আর আসে না। সেটা হল হাকিম! আর আমি? পাঠশালার সেরা ছেলে মজাই তাড়ি আর নেশা, মাঠে মাথার ঘাম পায়ে–।
শঙ্কার ছায়া জাগে আজহার খাঁর মনে। আমজাদের কানে এইসব কথা যায় না। সে আনন্দে তরমুজ খাইতে ব্যস্ত।
ওর বাবা শহরে ছেলেকে নিয়ে গেল। পেটানো গাধা একদম মানুষ। হাকিম!
চোখের তারা উপরে তুলিয়া কল্কে হাতে চন্দ্র ভঙ্গি করে।
তুমি বলল নসীব- কপাল! ছো-ছো। হরি চক্কোত্তি বছর বছর জমির খাজনা সাধতে আসে। আমার বাবাকে না খাজনা দিতে হত, আমাকে না খাজনা দিতে হয়, আয়-উপায় বাড়ে, দেখি কোন্ দিকের জল কোন দিকে গড়ায়। কার কপাল কত চওড়া হয়, দেখা যাক।
আজহার চন্দ্রের কথা মন দিয়া শোনে। কোনো উত্তর দিতে পারে না। এই ধরনের কথা বলে দরিয়াবিবি। কারো সঙ্গে আজহারের মিল নেই। এদিকে আমজাদের তরমুজ খাওয়া পুরোদমে চলিতেছে। পুত্রের ভবিষ্যৎ একবার মাত্র উঁকি দিয়া গেল আজহারের মনে। চকিত ছোঁয়াচ মাত্র। উল্টোপাল্টা কথা তার ভালো লাগে না। উঠিয়া পড়িল আজহার।
চন্দর, এবার কল্কেটা দাও। এখনও বিঘেখানেক জমি মই দিতে বাকি।
দুইবার টান দিয়া কল্কে ফিরাইয়া দিল আজহার।
কয়েত-বেলের গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা বলদ দুইটি চোখ বুজিয়া রোমন্থন করিতেছিল। আজহারের আগমনে উঠিয়া দাঁড়াইল। কর্তব্য সম্বন্ধে পশু দুটি যেন সর্বদা সচেতন!
মই জুড়িয়া আজহার জমির উপর নামিল। জমিতে শকরগঞ্জ আলু দিবে এইবার আজহার খাঁ।
আমজাদের তরমুজ খাওয়া সমাপ্ত। সে হাতমুখ গামছায় মুছিয়া ধন্যবাদ জানাইল, তোমার তরমুজ খুব ভালো, চন্দ্র কাকা।
ওই তরমুজটা নিয়ে যেয়ো তোমার মায়ের জন্য। ভাবী আজ কী বেঁধেছিল।
আমজাদের বয়স সাত বছর। সাধারণ দীন ব্যঞ্জন। লোকের কাছে তা প্রকাশ করতে নাই। বালক সে-বিষয়ে সচেতন। কোনো জবাব দিল না সে।
বেশ, আমায় একদিন নেমন্তন্ন করো।
অস্ফুট আচ্ছা শব্দে জবাব দিল আমজাদ।
আজের-ভাই, ছেলে আমার তরমুজ-ক্ষেত দেখে আসুক, তোমার তো বাড়ি যেতে দেরি আছে?
আচ্ছা, যাক। দেরি করো না, আমু।
দেরি করব না, বাবাজি।
চৈত্রের বৈকাল। আকাশে খণ্ড মেঘেরা মন্ত্রণারত। সমগ্র প্রান্তর আবার কর্মকলরবে জাগিয়া উঠিতেছে। ঝড় না উঠিলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রবি-ফসলের ক্ষেতে কাজের কামাই নাই। শুক্লা সপ্তমী। চাঁদের আলোয় খরা-ভীত কিষাণেরা বহুক্ষণ মাঠ গুজার করিয়া রাখিবে আজ।
অবাক হইয়া চারিদিকে তাকায় আমজাদ। মাঠের নিবিড়ে সে কোনোদিন প্রবেশপথ পায় নাই চেনাশোনা সড়ক ছাড়া। আজ চন্দ্ৰকাকার সঙ্গে জলা-জাঙালের পথ ভাঙিতে লাগিল সে।
পটল-বাড়ির মাঝখানে তামাকের গাছ উঠিয়াছে। হাত দুই দীর্ঘ। শাদা ফুল ফুটিয়াছে তামাক গাছে। আমজাদ সেদিকে চায় না। পটলক্ষেতের ধারে ধারে লঙ্কাগাছ অনেক। একটা গাছের কাছে আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।
এমন লঙ্কা সে আগে দেখে নাই। লাল রঙের লঙ্কা আকাশের দিকে পা তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তারই মতো ডিগবাজি দিতেছে যেন। চন্দ্র আগে-আগে ছিল। পেছনে তাকায় সে।
আরে আমু চাচা, দেখছ কী?
এগুলো কী লঙ্কা, চন্দ্র কাকা?
অবাক হয় কোটাল।
চাষীর ছেলে হয়ে এই লঙ্কা চেনে না? সুজজু-মুখী লঙ্কা। তুলে নাও কতগুলো। আমজাদ ইতস্তত করে। পরের জমি।
চন্দ্র নিজেই কতগুলো লঙ্কা আমজাদের হাতে তুলিয়া দিল। নীল পাতা ভেদ করিয়া লাল রঙের ফুটকি সূর্যমুখী ছাড়া আর অমন কী গাছ আছে? অবাক হইবারই কথা। আমজাদ লঙ্কাগুলি লুঙির একদিকে বাঁধিয়া রাখিল। কিন্তু ফসলের উপর হইতে চোখ সে সহজে ফিরাইতে পারে না। পরদিন মাঠে আসিলে সে এই ক্ষেতের কথা বিস্মৃত হইবে না।