হারুন : ওখানে কেন?
মশ্রুর : দেখুন, আলি-শান।
হারুন : মশ্রুর, তুমি শুধু তেলেসমাতি ধাঁধা সৃষ্টি করছ।
মশ্রুর : এবার দেখুন।
হারুন : ও ত গোলাম বসতের ঘর। কিছু মাটি উঁচু করে ফেলে দিওয়ানের মত বানিয়েছে। উপরে বিছানা পাতা। বেশ রঙীনই মনেহয়। গোলামের ঘরে–এই তাকিয়া? আর ত কিছু দেখা যাচ্ছে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আপনি শুধু দেখে যান।
হারুন : আমি ত দেখছি-ই।
পাশাপাশি উপবিষ্ট মশ্রুর ও হারুনর রশীদ। কত রাত্রি কে জানে? গাছের কয়েকটা ডাল এক জায়গা থেকে বেরিয়েছে। এমন খড়ি। বেশ হেলান দিয়ে এখানে বসা যায়। কিন্তু কৌতূহলী মানুষ ত আরামের স্বাদ-প্রার্থী নয়। আমিরুল মুমেনীন ও মশ্রুর শিরদাঁড়া সটান মনোনিবেশে দৃশ্য দেখতে লাগলেন। শোনার ক্ষেত্র নেই, বলা বাহুল্য।
গোলাম-বসতের সাধারণ মাটির ঘর যেমন হয়, এই ঘরের মশালা তার চেয়ে অন্য কিছু নয়। কিন্তু তবু পরিপাটি আছে। মাটির দিওয়ান জানালার পাশে। মরুভূমির লু’হাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সমস্ত ঘরের জানালা উঁচুতে। যেন সোজাসুজি বাতাস মুখে না লাগে। গাছের পাতার তৈরি দুই পাল্লা। কখনও বন্ধ, কখনও খোলা থাকে। নিচের রাস্তা থেকে কিছু দেখা যায় না। অনেক উপর থেকে ঘরের মেঝে চোখে পড়ে।
হঠাৎ মেটে দিওয়ানের উপর এক হাব্সী নওজোয়ান এসে শুয়ে পড়ল, ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। তার পেছনেই এলো আরমেনী এক তরুণী। সে বসে পড়ল এক পাশে। হাতে একগোছা আঙুর। গুচ্ছ সমেত সে হাব্সী নওজোয়ানের ঠোঁটের উপর ধরে ও নাড়াতে থাকে। হাব্সী আঙুরের লোভে ঠোঁট বাড়ায়। তরুণী তখন দ্রাক্ষাগুচ্ছ উপরে তুলে নেয় আর মিটিমিটি হাসে। হাব্সী জোয়ান এবার বালিশ থেকে আরো উর্ধ্বে মুখ তোলে, কিন্তু আঙুর গুচ্ছ তেমনই আরো উপরে সরে যায়।
কথা শোনা যায় না, তবু কেউ কাছে থাকলে শুনতে পেত বৈকি।
তরুণী : তুমি বড় লোভী, তাতারী? তোমার সবুর সয় না।
যুবক : মেহেরজান, সবুর করা যায় না। ভাল মেওয়া দেখলে জিভে পানি এম্নি আসে।
তরুণী : এসো, আর একবার চেষ্টা করো, তোমার ঠোঁটের কাছে আঙুর ঝুলিয়ে ধরি।
যুবক : তোমার ঠোঁটে আরো বেশী মেওয়া আছে।
তরুণী: বেশ, তাই খাও। কিন্ত আঙুর পাবে না।
যুবক : আঙুরে আমার প্রয়োজন নেই। ও আমার আমাদের নসীবে জুটে না। বেগম জুবায়দার মেহেরবানী, আঙুর-ও জুটছে।
তরুণী : শুধু আঙুর? আর কিছু না?
যুবক : সেই মেওয়া—
উভয়ের হাস্যধ্বনি আর কামরার ভেতরে আবদ্ধ থাকে না। এই প্রাণ হাসি শুধু এই মুহূর্তে পাওয়া যায়–হৃদয় যেখানে হৃদয়ের বার্তা উপলব্ধি করে, সান্নিধ্যের ব্যগ্রতায় নিজের অস্তিত্ব আর আলাদা রাখতে নারাজ। বাতাস হয়ত লোভেই ছুটে আসে তার তরঙ্গে নতুন সুর জুড়ে দিতে। বাতাসকে এখানে আমন্ত্রণ দিতে হয় না।
যুবক : মেহেরজান, আগে এই মেওয়া দাও। তারপর তোমার মেওয়া দিও।
তরুণী : আবার চেষ্টা করো।
যুবক : না। আমি এই মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম।
তরুণী : আহা, রাগ করো না। আজ আমিও সবুর করতে পারব না। ভয় হয়। খলিফার কানে গেলে—
যুবক : ভেবে লাভ নেই, মেহেরজান। বেগম সাহেবা যখন আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আমি আর ডরাই না।
তরুণী: এসো, আঙুর খাও। আমি ত তোমার জন্যে আনি। বেগম সাহেবা আমাকে রোজ অনেক কিছু খাওয়ান।
যুবক : মেহেরজান, তুমি ভারী সুন্দর, তোমার কথার মতই সুন্দর। বিধাতা তোমাকে ঝুটো করেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
তরুণী: ঝুটো?
যুবক : বিধাতা ত সব জানেন। তোমার ভূত-ভিবষ্যৎ। এই আঠারো বছরে তুমি কি দাঁড়াবে তা ত তিনি জানতেন। সেই কল্পনার মূর্তিতে তিনি কি তোমার ঠোঁট আস্ত রেখেছেন, মেহেরজান?
তরুণী : তিনি কি করেছেন জানি না, তুমি ত—
আবার সেই উতরোল হাসি ওঠে এই জীর্ণগৃহের মধ্যে। ফিরদৌস (বেহেশতের নাম) ত দূরে নয়। বুকের কপাট খুললে যে হাওয়া বেরোয় তারই স্নিগ্ধতা আর শীতলতা দিয়েই বেহেশ্ত তৈরী। আজকের হাসি সহজে থামা জানে না। লয়ান্তরের মত তারি মধ্যে তরুণী মুখের কথা ছড়িয়ে যায়।
তরুণী : বিধাতার উপর খালি চুম্বনের অপবাদ কেন? রসিক কী সেখানেই শুধু থেমে থাকতে পারে?
যুবক : আহ মেহেরজান—
যুবক আর দিওয়ানে শুয়ে থাকে না। ধড়মড় উঠে পড়েই সে তরুণীকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে। তারপর বিধাতার উপর যে অপবাদ দিয়েছিল সে তারই অভিনয় শুরু করে। চারি চক্ষুর মিলন, বহু শতাব্দীর প্রবাদ। ঠোঁটের কথা কেন কেউ কোনদিন উল্লেখ করে নি?
যুবক : (ফিস্ফিস্ কন্ঠে) তোমার বুকের মেওয়া কি কম মধুময়, মেহেরজান।
তরুণী : তুমি যে কতদিনের দুর্ভিক্ষে উপবাসী। খালি খাওয়া ছাড়া আর কোন কথাই নেই মুখে।
যুবক : উপবাসী, অনাহারী। নিশ্চয়ই তোমার মত ইফতারীর জন্য আমি সারা জন্ম উপবাসী থাকতে রাজী। কিন্তু আর কথা বলব না।
তরুণী : তুমি আমার সদরিয়া, কাঁচুলী খুলছ কেন? তোমার দুই হাত আমি ভেঙে দেব। খাওয়া ছেড়ে এবার চাওয়া ধরেছ।
যুবক : মেহেরজান, তুমি সত্যি, সত্যি মেহেরজান। প্রাণে করুণা ঢেলে দিতে পারো।
তরুণী : আমার খোলা সীনায় তোমার ঠোঁট তাতারী। আগে আমার ঠোঁটে ছিল তোমার ঠোঁট। তোমার অধঃপতন ঘটছে, ক্রমশঃ নীচের দিকে নামছে। কোথায় গিয়ে যে থাম্বে–যাও।
কৃত্রিম ক্রোধ ও হাসির যুগল-ডানায় সওয়ার মেহেরজান। বাহুপাশ ছাড়িয়ে, দিওয়ানের পাশে দাঁড়ায়। সমস্ত শরীর নগ্ন। পরনে শুধু ঘাগরা।