মশ্রুর জবাব দিলে, “আলম্পানা, ওদিকে ত হাব্সী গোলামেরা থাকে।”
হারুন : হাব্সী গোলাম?
মশ্রুর : হ্যাঁ, বাদশা-নামদার।
হারুন : গোলামেরা এমন হাসি হাসতে পারে?
মশ্রুর : পারে, আমিরুল মুমেনীন। ওরা সুখ পায় না, কিন্তু সুখের মর্ম বোঝে।
মনুষ্যত্বহীন, কিন্তু মনুষ্যত্বের আস্বাদ পায়। ওরা হাসে।
হারুন : মনে হয় কোন জ্বীন-পরীর হাসি। কিন্তু কান দিয়ে শোন ত। মিহি-মোটা দু-রকম হাসি যেন একত্রে মিশে বাতাসের লাগাম ধরে আছে।
মশ্রুর : তা-ই মনে হয়।
হারুন : কিন্তু কারা হাসছে? কোন মানব-মানবী? কোন মানব-মানবী একত্রে?
মশ্রুর : গোলামের হাসি, জাঁহাপনা।
হারুন : ওরা হাসবে, আমি হাসতে পারব না? না, তা হয় না।
মশ্রুর : হাসি থেমে গেল, জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : হ্যাঁ। তা-ই মশ্রুর। কিন্তু ওর রেশ আমার কানে এখনও বাজছে।
মশ্রুর : সত্যি, অদ্ভুত হাসি।
হারুন : মশ্রুর, চেয়ে দেখো ওই দিকে। ওই খুবানির গাছের ডাল যেখানে দেওয়ালের লাগালাগি মিশেছে কে যেন সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ল।
মশ্রুর : না, জাঁহাপনা। এখানে কে আসবে? কার এত সাহস?
হারুন : একটু এগোও। দেখো, ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ডাল যেমন কাঁপে, খুবানির শাখা তেমনই কাঁপছে।
মশ্রুর : আমিরুল মুমেনীন, কোন নিশাচর পাখি বসেছিল, হয়ত এখনই উড়ে গেল। তার ডানার ঝাঁপটের শব্দে এমন মনে হয়। হারুন : হয়ত তা-ই। এখন কত রাত্রি?
মশ্রুর : আলম্পানা, ঐ ত দজ্লা নদীর উপরে আদিম-সুরত হেঁটে হেঁটে দূরে নাম্ছে! আর বেশী প্রহর বাকী নেই শুকতারা ওঠার।
হারুন : চলো, এখন মহলে ফিরে যাই। এই রাত্রির কথা যেন কেউ টের না পায়, মশ্রুর। আহ, ঐ হাসি আমি হাসতে পারতাম! কাল আবার আমাদের তালাসী নিতে হবে–এমনই রাত্রে।
মশ্রুর : আসসামায়ো তায়তান–-শ্রবণ অর্থ পালন।
হারুন : মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : আজ আমি ঘুমাব, অনেক-অনেক ঘুম। কাল দরবার হবে না, ওদের বলে দিও। আমি শুধু হাসি শুছি। আমি এমনই হাসি হাসতে চাই। চলে। …
০৩. হারুনর রশীদের কওসুল-আকদার
হারুনর রশীদের কওসুল-আক্দার বা সবুজ প্রাসাদ রাত্রির নৈঃশব্দ্য-মোড়কে কৃষ্ণবর্ণ। মহলের কোথাও কোথাও আলো জ্বলছে, কিন্ত উদ্যান আগেকার মতই সুপ্তি-মগ্ন, অন্ধকার। খোজা প্রহরীরা কোথাও কোথাও নিজের জায়গায় মোতায়েন আছে। তাদের দেখা যায় না। জুতার আওয়াজ নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ওঠে নি এখনও। বাতাসের গোয়তি হয়ত শব্দ তোলে, কিন্তু তার ছোঁয়াচ নির্জনতা ভেদ করতে পারে না। সৃপ্তির বর্ম এখানে বড় কঠিন।
“মশ্রুর, ধীরে”, আবার কাফ্তান গোলাপ ডালের কাঁটায় বিঁধে গিয়েছিল, তা ছাড়াতে ছাড়াতে খলিফা হারুনর রশীদ বলেন।
“জাঁহাপনা, আজ কেউ আর হাসছে না।” মশ্রুর জবাব দিলে।
দু’জনে হাঁটছিলেন উদ্যানের সাধারণ রক্তিম পাথরের পথ ছেড়ে, ঘাসের উপর, গাছের কোল ঘেঁষে ঘেঁষে। নির্জনতার প্রান্তরে অজ্ঞাতবাস বিক্ষত হৃদয়ের প্রলেপ। হয়ত সেই জন্যে অথবা অন্য কারণে আমিরুল মুমেনীন হাঁটছিলেন। আজ তার দেহাবয়বে চাঞ্চল্য প্রায় অনুপস্থিত। হাঁটছেন, দু’একটা কথা বছেন। আবার কান খাড়া করছেন। ছায়ার মত সঙ্গী মঞ্জর অন্ধকারে যেন নিঃশ্বাসের বাতাস।
–মশ্রুর।
–জাঁহাপনা।
–কিছু শুনতে পাচ্ছো?
–হ্যাঁ, জিল্লুল্লাহ্। সেই হাসি। দাঁড়াও, চুপ করে শোনো।
–আজ আরো স্পষ্ট, আরো তীব্র।
–মানব-মানবীর মিলিত হাসি।
–গোলামেরা এত রাত জেগে থাকে।
–থাকে, জাঁহাপনা! বিশ্রাম অর্থ ত শুধু ঘুম নয়।
–এগোও, দেখা যাক্ কোন্ দিক থেকে এই হাসির শব্দ আসে।
তারা দু’জনে এগোতে লাগলেন। কাওসুল আারের বিস্তৃত দেওয়ালের ওপার থেকে বিচ্ছুরিত হাসির অনুরণন ছুটে আসে। আর কিছু বোঝা যায় না। দু’জন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে শোনেন, খোলা আকাশের নীচে। সূর্ত এই হাসির পরিমাপ শুধু শব্দে করা চলে না। কর্ণপটে আশাবরী রাগ তারা গ্রামে পৌঁছে যে-সুরের ঝিকিমিকি রচনা করে এই হাসি প্রায় তারই তুলনা। কিন্তু মানুষ এই হাসি হাসতে পারে–বিশেষ করে গোলামেরা? আমিরুল মুমেনীন প্রশ্ন তুললেন ফিস্ ফিস্ কণ্ঠে।
জবাব দিলে মশ্রুর, “জাঁহাপনা, চলুন। প্রহরীদের সঙ্গে নিয়ে এর তল্লাশ শেষ করি।
হারুন : না, মশ্রুর, এত হট্টগোলে হয়ত সব পণ্ড হয়ে যাবে। বুলবুলের ডাক বনের আড়ালে বসে শুনতে হয়।
মশ্রুর : আমি কিন্তু বুলবুল দেখার পক্ষপাতী, আলম্পানা।
হারুন : আমি কিন্তু কম পক্ষপাতী? কিন্তু এত তাড়াহুড়ায় হয়ত কোন খোঁজ পাওয়া যাবে না। বুলবুল উড়ে পালাবে।
মশ্রুর : তার চেয়ে আমাকে দুই রাত্রি সময় দিন, আমি সব হদিস বের করব।
হারুন : বেশ। দু’দিন বহু কাজ আছে। শুনেছি রোমের সুলতান সেই হতভাগ্য নিসিফোরাসের বহু সমর্থক গুপ্তঘাতক সেজেছে। আমিরদের আমিরী চালে নানা গলদ ঢুকেছে। তাই নানা কাজ, আমি দু’দিন ব্যস্তই থাকব। তুমি বের কর হাসির হদিস।
মশ্রুর : আস্সাময়য়া তায়তান।
হারুন : কিন্তু মনে রেখো, মশ্রুর। দু’দিন সময়। তার বেশী নয়।
মশ্রুর : বান্দার গর্দান জিম্মা রইল, জাঁহাপনা।
হারুন : বেশ। এবারকার যুদ্ধে রোমের বহু গোলাম বন্দী হয়েছে। বাজারে গোলামের দাম খুব সস্তা। ওরা তবু হাসে? আর এই হাসি অসম্ভব মনে হয়।