মশ্রুর : আলম্পানা।
হারুন : আব্বাসা আমার সগ্গা সহোদর বোন। হা-হাঃ।
মশ্রুর : জাঁহাপনা–।
হারুনর রশীদ মরুরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন, হাব্সী জল্লাদ চক্ষু তোলার সাহস পায় না। পায়চারী-সচল মুহূর্ত পৃথিবীর মতই ঘূর্ণমান। কিন্তু সমান তাল ও রেখায় নয়। আমিরুল মুমেনীন আবার হঠাৎ থেমে মৃদু কণ্ঠে বলেন, “মশ্রুর, আমি স্মৃতি উপড়ে ফেলতে চাই, সমস্ত স্মৃতি।”
মশ্রুর : চলুন, বাগানে যাই। নারঙ্গী বনে ফুল ফুটেছে। কোথাও জাম্বুরায় পাক ধরছে। বাগানে অঝোর গন্ধ। খোশবু মনের বোঝা হাল্কা করে আলম্পানা।
হারুন : তা-ই চলো। হারেমের এই কামরা আমার কাছে দোজখ। স্মৃতির হাবিয়া
নরক আমার খুন শুকিয়ে দিয়েছে। গুম-খুন আমার ঘুম। এখানে আর না। মশ্রুর ঠিকই বলেছিল। ফল আর ফুলের খোশবুর সঙ্গে জুটেছিল ঠাণ্ডা হাওয়ার হাল্কা স্পর্শ। থোকা থোকা অন্ধকার কোথাও জমাট, কোথাও ঈষৎ ফিকে। তাই এখানকার বহুমাত্রিক দুনিয়া বহুমাত্রিক মনের নাগাল পায় বৈকি। পায়ের নিচে ঘাসের কোমলতা অন্যান্য অঙ্গের সান্নিধ্য খোঁজে। মিটিমিটি নক্ষত্র বর্তিকা বাঁদীর কর্তব্য-সমাপনে নেমে আসে।
পায়চারী করতে করতে খলিফা বলেন, “মশ্রুর, তোমার কথামত ঠিক জায়গায় এসেছি। আমি মনে শান্তি পাচ্ছি। আগুনের জ্বালা আর পোড়ায় না। আঁচ, আঁচ ত থাকবেই।”
মশ্রুর : শুক্রিয়া, জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, তোমার মনে পড়ে, আমরা চারজনে কতদিন বাগদাদের সড়কে, কতো বেগানার কত রাত কাটিয়ে দিয়েছি?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মওতের আগে তক্ বান্দা তা ভুলতে পারবে না।
হারুন : মনে পড়ে … মণিকার মাজারের মহলে সেই রাত্রির কথা? অদ্ভুত সেই আওরত–শাদীর সময় যার শর্ত ছিল শওহর ব্যভিচারী হোলে, দু’শ’ কোড়া দুই পাঁজরে খেতে হবে। দুই চক্ষু উপড়ে তুলে দিতে হবে। … মনে পড়ে?
মশ্রুর : কেয়ামৎ তক্ মনে থাকবে, বান্দা নওয়াজ, ভৃত্যপালনকারী।
হারুন : মনে পড়ে, সিন্দবাদ নাবিকের কথা? তার হপ্তম সফরের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী?
মশ্রুর : বান্দার স্মৃতিশক্তির পরিচয় ত আপনার জানা আছে, জিলুল্লাহ।
হারুন : সব মনে আছে। জাফর আর আব্বাসা কবরে শুয়েও ভুলে যায় নি। কিন্তু আমি ভুলে যেতে চাই।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, সে-সব কথা আর তুলবেন না। চমৎকার রাত্রি। আপনি যদি মঞ্জুর করেন, কবি ইস্হাককে ডেকে আনি। তার গজল শোনা যাক।
হারুন : না, মশ্রুর। নির্জনতাই আমার পছন্দ। এখানে রাত্রির হাওয়া পাঁজরের দাহ নিভিয়ে দিতে পারে। কবির জায়গা আর কোথাও। ওরা বুকের কল্লোল আরো বাড়িয়ে তোলে।
মশ্রুর : বান্দা-নওয়াজ, ভৃত্য-পালক, তবে চলুন–শহরের সড়কে হাঁটি। বগ্দাদ শহর ত ঘুম জানে না। কোথাও না কোথাও কিছু পাওয়া যাবে, মনের বাতাস ফেরাতে।
হারুন : না মশ্রুর। এই লেবাসে অসম্ভব। আর দুজনে ত বহুদিন বেরোই নি। উম্মায়েদ খুনীদের গোয়েন্দা, গুণ্ডা কোথায় কিভাবে ওঁৎ পেতে আছে, কে জানে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, উম্ময়েরা কর্দোবা শহরে পালিয়েছে। ওরা আর এদিকে চোখ ফেরাবে না। হারুন মশ্রুর, খেলাফৎ ত পাও নি। বুঝবে না রাজত্বের লোভ কত। ওই লোভের আগুনের কাছে হাবিয়া-দোজখ সামাদানের ঝিলিক মাত্র। বিবেক, মমতা, মনুষ্যত্ব–সব পুড়ে যায় সেই আগুনে। উমাইয়ারা আমার বংশ প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাসকে গাল দেয় সাফফাহ–রক্তপিপাসু বলে–আর ওরা? জাল দরিয়ার তীরে যদি আবুল আব্বাস হেরে যেত? জয় বা পরাজয়ের গ্লানি মেটাতে পরাজিতদের গাল দেওয়া একটা রেওয়াজ হোয়ে দাঁড়িয়েছে। উমাইয়াদের পাশা যদি ঠিক পড়ত তখন? নীতি এখানে বড় কথা নয়। বল–লোক-বল, অস্ত্র-বল, অর্থ-বল সব নীতির মাপকাঠি। তাই দুজনের বগ্দাদ শহরে এই অবস্থায় পায়চারী করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, উমাইয়াদের ঘাড় অত তাকৎ রাখে না।
হারুন : না রাখুক। হুঁশিয়ারী ভাল, হুঁশিয়ারী ভাল, মশ্রুর।
মশ্রুর : জিলুল্লাহ, আপনার মহল এই “কাওসুল আক্কারের” বাগানে কতদিনের পুরাতন গাছ রয়েছে।
হারুন : বহুদিনের। আব্বাজান মরহুম মেহদী বলতেন–দুইশ’ বছর আগে এখানে–কিন্তু ও কি, মশ্রুরয়
মশ্রুর : কি, জাঁহাপনা?
হারুন : (উৎকর্ণ) ওই
মশ্রুর : কি, আমিরুল মুমেনীন?
হারুন : তুমি শুনতে পাচ্ছে না?
মশ্রুর : না, আলম্পানা।
হারুন : হাসি, হাসি–কে যেন হাসছে।
মশ্রুর : হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
হারুন : আমার মহলের গায়ে কে হাসছে এত রাত্রে এই হাসি–একটু চুপ করো।
খলিফা হারুনর রশীদ ঠোঁটে তর্জনী রেখে ইঙ্গিত করলেন, একদম নিঃস্তব্ধ দাঁড়াও। সত্যি, চতুর্দিকের সুসাম বিয়াবান যেন হাসির মওজে দোলা খাচ্ছে। খুব জোর হাসি নয়। অস্পষ্ট। তবু তার রণন উৎসমুখের খবর পাঠায়। উৎকর্ণ কিছুক্ষণ শোনার পর, হারুনর রশীদ স্তব্ধতা ভেঙ্গে উচ্চারণ করলেন, “মশ্রুর। শুনেছো এমন হাসি? কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয় না। এই উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ–দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে–বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন–আমার হিংসা হয়, মশ্রুর। আমি বগ্দাদ-অধীশর সুখ-ভিক্ষুক। সে ত আমার তুলনায় বগ্দাদের ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?