–আচ্ছা, বেগম সাহেবা।
–খোদা হাফেজ। ফি আমানীল্লাহ।
নীচে তরুলতা শোভিত প্রাঙ্গণ চত্বর। তারপর বাগানের সীমানা শুরু। বাতাবী লেবুর সারি, দ্রাক্ষাকুঞ্জ–অন্যান্য গাছের ঘন সন্নিবেশে রাত্রি অন্ধকার-জমাট। পথের হদিস পাওয়া কষ্টকর। বেগম জুবায়দা অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাঁদী মেহেরজান কি কালো অন্ধকার, না হাব্সী গোলামের কালো বুকে এতক্ষণে হারিয়ে গেল?
আখরোট-খুবানী ডাল ঝুলে আছে ওইখানে পুব দরওয়াজার দু’পাশের দেওয়ালের পাথর ঘিরে। তারই নীচে তো তাতারী প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। ডালের ঝোঁপ ছেড়ে মেহেরজান কখন তার হাতে হাতে দিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
হাব্সী গোলাম আজ অপেক্ষা করবে ত? দাঁড়িয়ে থাকবে না স্পন্দিত বুকে, সারাদিনের কঠোর ক্লান্তির পর?
বেগম জুবায়দার মনে সেই প্রশ্ন, মেহেরজানের মনে সেই প্রশ্ন।
০২. প্রাসাদ-কক্ষে হারুনর রশীদ
প্রাসাদ-কক্ষে হারুনর রশীদ পায়চারী-রত। মুখে আবেগ-চাঞ্চল্যের ছাপ। বারান্দায় পদধ্বনির শব্দে উৎকর্ণ বগ্দাদ-অধিপতি হেঁকে উঠলেন, “কে?”
জবাব আসে “জাঁহাপনা, বান্দা-নেওয়াজ, আমি মশ্রুর।”
হারুন : এসো, এসো মশ্রুর। আজ আমি বড় একা। হ্যাঁ, একা।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আর্মেনিয়া থেকে একশ’ মুজ্রানী-নর্তকী আনিয়েছি। ওদের ডাক দেব, হুকুম দিন।
হারুন : বড় একা, মশ্রুর। মুজরানী দিয়ে শুন্যতার সেই বোধ দূর হবে না।
মশ্রুর : হুজুর, আপনার যা খায়েশ, শুধু বলুন। আসসামায়ো তায়াতান। (শ্রবণ অর্থ পালন)। হারুন : না, কিছু না। বড় একা লাগছে। আজ জাফর বামেকী নেই, আব্বাসা নেই।
মশ্রুর : জনাবে আ’লা, সেদিনও আপনার ফরমাবরদার গোলাম কোন কিছু অমান্য করে নি।
হারুন : হ্যাঁ, মশ্রুর। তোমার আবলুস কালো দেওয়ের মত কদ, তোমার পাহাড়ের মত বাজু–সব সময় আমার আর তলওয়ারের ইজ্জৎ রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু আমার বুকের পাষাণ-ভার নামাতে পারে না? তুমিই একমাত্র পুরাতন বন্ধু রয়ে গেছে। আর সবাই ওপারে।
মশ্রুর : আলম্পানা—আলম্পানা—
হারুন : দহসৎ–ভয় পেয়ো না। আমি এখন আমিরুল মুমেনীন হারুনর রশীদ নই। আমি দরবারে নেই–হারেমে আছি। আমি তোমার বন্ধু, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আপনি যেদিন রাত্রে উজীরে আজম জাফর বার্মেকীর কতল পারোয়ানা লিখলেন, তখন বার বার ফিরে এসেছি তার দরওয়াজা থেকে। আপনার কাছে নাফরমান সাজতে পারব না–আবার ছুটে গিয়েছি। আপনি সবুর করলেন না।
হারুন : মশ্রুর, আজো নিজের বিচার মানুষ নিজে করতে শেখেনি। সে খোদ্কসী (আত্মহত্যা করতে পারে, যেমন সে রোজ গোস্তের জন্য দুম্বা কি গাইকসী করে, কিন্তু নিজের বিচার করে না। সে-কথা আর উত্থাপন করো না কোনদিন।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, গোস্তাখি মাফ করবেন। মা’জী মা’জী–অতীত অতীত। তা আর কবর খুঁড়ে তুলবেন না।
হারুন : মশ্রুর, মানুষের লাশ কি কবরে পড়ে থাকে আর পচে?
মশ্রুর : আলেমরা সেই রায় দেয়।
হারুন : না, না–মশ্রুর। দিওয়ানে এতক্ষণ বসেছিলাম। এখন পায়চারী করছি। কেন জানো? লাশ কবরে শুয়ে থাকে না। লাশ কথা বলে। তার ধাক্কা আরো শক্ত আরো কঠিন। জেন্দা মানুষের কণ্ঠ সেখানে ক্ষীণ ফিসফিসানি, ভাঁড়ার ঘরে নেংটি ইঁদুরের পায়ের আওয়াজ মাত্র। বসে থাকতে পারলাম না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মন থেকে সব মুছে ফেলুন।
হারুন : সবে মুছে দিতে পারি। কিন্তু স্মৃতি, মশ্রুর? স্মৃতি লাশ জেন্দা করে তোলে।
মশ্রুর : স্মৃতি সমস্ত কওম-কে জেন্দা করে তুলতে পারে, জনাব। কিন্তু আলম্পানা, সকলের স্মৃতিশক্তি থাকে না। হাবা বোবারা যেমন। তবে অতীতের কথা অনেকে বলে। সে ত এগোতে না পেরে, দুঃসহ বর্তমান থেকে পালানোর কুস্তি-প্যাঁচ মাত্র। ও এক রকমের ভেল্কি, জীবনী-শক্তির লক্ষণ নয়। বলিষ্ঠ মানুষেরই স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন হয় সামনে পা ফেলার জন্য।
হারুন : আহ্ মশ্রুর, তুমি ত শুধু জল্লাদ নও, তুমি আলেমুল আলেম। পণ্ডিতের পণ্ডিত। তাই ত আমার বন্ধু। কিন্তু স্মৃতি আমাকে ঘুমাতে দেয় না।
মশ্রুর : চলুন, কিছুদিন বগ্দাদের ঝামেলা ছেড়ে আর কোথাও যাই।
হারুন : কিন্তু আব্বাসা আমার সঙ্গ ছাড়বে? না-না। ঘরের মধ্যে জ্যান্ত, কবরে দাফন হোলো তার। সোজা কথায়, পুঁতে ফেলোম। কতটুকু তার অপরাধ? জাফরের প্রতি মহব্বৎ–কিন্তু আমি কি?
খলিফা হারুনর রশীদ হা-হা-রবে প্রায় উন্মত্তের মত হেসে উঠলেন। পায়চারী করতে লাগলেন। হাব্সী মশ্রুর মাথা-নীচু, তহরীমা বাঁধার ভঙ্গী বুকে দুই হাত, পাথর-মূর্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। হারুনর রশীদ পায়চারী হঠাৎ থামিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মশুরুরের বুকে মৃদু তর্জনী আঘাত করলেন। আবার হা-হা হাসি। তারপরই পায়চারীরত অবস্থায় বলে উঠলেন, “কতটুকু তার অপরাধ? জাফরের সঙ্গে কি রকম শাদী দিলাম? ‘আকদ’ হলো অথচ রসুমৎ হবে না কোনদিন। শক্ত শর্ত। কঠিন কারার। মশ্রুর”—
মশ্রুর : আলম্পানা।
হারুন : আব্বাসা বাকী কাজ নিজে তামাম করলে। রসুমৎ-ব্যবস্থার ভার নিজের হাতে নিলে যা বেরাদর নিলেন না। শর্ত ভঙ্গের কঠোর শাস্তিও দিলাম। আব্বাসী কওমের খুন বার্ষেকী কওমের সঙ্গে মিশে নাপাক হবে–না, তা হতে দিতাম না মশ্রুর—