হারুন : ভাবছি, এত দৈহিক যন্ত্রণা এরা সহ্য করে কিভাবে?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আবু নওয়াস বলে–মানুষ আনন্দাতীত আরো কিছু পায়, যার কাছে এই যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা মনে হয় না।
হারুন : আনন্দাতীত–ও একটা পাগলের প্রলাপ। আবুনওয়াসই তা বলতে পারে।
মশ্রুর : আমি কিন্তু এই কয়েদীকে দেখে তা প্রায় বিশ্বাস করতে বসেছি।
হারুন : তুমিও বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, অথবা এরা বোধ হয় মানুষ নয় অথবা মানুষ যা দিয়ে তৈরি এদের উপাদান তার চেয়ে আলাদা।
হারুন : তোমার পাগল হতে বেশি দেরী নেই। এই দ্যাখো…
[এতক্ষণ তাতারী দাঁড়াইয়াছিল। শরীরে বোধ হয় অব্যক্ত যন্ত্রণা, তাই ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল। জায়গাটা বালুময়। হতব্যক্তির রক্ত পরিষ্কারের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা। তাতারী বসিয়া পড়িল। তারপর দুই গোড়ালি চাপিয়া ধরিয়া মাথা দুই হাঁটুর মধ্যে খুঁজিয়া দিল। সবই নিঃশব্দে ঘটে।]
মশ্রুর : জাঁহাপনা–
হারুন : আস্তে আস্তে, মশ্রুর।
[দুই জন ফিসফিস্ কণ্ঠে কথা বলে]
আস্তে, একটু বিশ্রাম নি।
মশ্রুর : ওর বিশ্রামের প্রয়োজন নেই।
হারুন : আছে। একটু তেজ সঞ্চয় করে নি।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, তেজের উৎস আনন্দ। ওর তেজ হয়ত সেই এক জায়গা থেকেই আসে।
হারুন : মশ্রুর। তুমি বড় বাজে বকো। শুধু দেখো, দেখো। ওর তেজের সব পরীক্ষা নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছি আজ। এই গোলাম—
[কথার ছেদ পড়ে। মেহেরজানের প্রবেশ। পরনে রেশমি লেবাস। যৌবন সর্বাঙ্গে ক্ষমাপ্রার্থীর মতো লুটাইয়া পড়িতেছে। চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ছাপাইয়া ওঠে। আপ্ত-রমণীর মতো চলাফেরা।]
মেহেরজান : জাঁহাপনা, কোথায় আপনার তামাসা? আমি—
হারুন : হঠাৎ পেছন ফিরে ধীরে, আস্তে—
[এবার সকলে খুব নিচু গলায় সংলাপ-রত]
মেহেরজান : বহুৎ আচ্ছা। কিন্তু আপনার তামাশা কোথায়? আমি ত কোতোয়ালের মাকানে বসে বসে হয়রান। শেষে আপনার ডাক যে পড়ল, তার জন্য শুরিয়া, ধন্যবাদ—
হারুন : তামাশা নিশ্চয় দেখবে।
মেহেরজান : কিন্তু কোথায়?
হারুন : আছে, বেগম সাহেবা।
মেহেরজান : কিন্তু কই?
হারুন: [উপবিষ্ট তাতারীর দিকে নির্দেশ] ওই—
মেহেরজান : ও কে?
হারুন : একটা নাফরমান, অবাধ্য কয়েদী, আমার কথার কোন ইজ্জৎ রাখে না।
মেহেরজান : ওর গর্দান দু-টুকরা করেন। ওর অপরাধ কি?
হারুন : তার শুমার নেই।
মেহেরজান : তবু—
হারুন : আমার অবাধ্য গোলাম।
মেহেরজান : চাবুক লাগান।
হারুন : তা-ই লাগিয়ে লাগিয়ে ত শরীরের ওই দশা।
মেহেরজান : বেশ করেছেন। কিন্ত গোলামটা কে?
হারুন : বলছি, সব বলব তোমাকে।
মেহেরজান : কে এই গোলাম, মশ্রুর?
হারুন : মশ্রুর ওর নাম জানে না।
মেহেরজান : তা মশ্রুর নিজের মুখেই বললে পারে। গোলামটা কে?
হারুন : তুমি এগিয়ে গিয়ে নিজেই জিজ্ঞাসা কর না।
মেহেরজান : বেশ।
[অগ্রসর হইয়া চত্বরের কিনারায় আসে,তারপর বেশ জোরেই ডাক দেয়। এরপর স্বাভাবিক কণ্ঠে সব সংলাপ]
কে–তুমি কে?
[হাঁটুর মধ্যে মুখ গোঁজা তাতারী প্রথম ‘ক’ শব্দে বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টের মত মাথা তোলে। তারপর ধীরে ধীরে মেহেরজানের দিকে দৃষ্টি-নিবদ্ধ রাখিয়া খাড়া হয়।]
তুমি কে?
(তাতারী উদভ্রান্তের মত জিঞ্জির-বাঁধা দুই হাত তোলার চেষ্টা করে]
কে তুমি?
[কোন জবাব আসে না। পেছনে ফেরে মেহেরজান]
কে এই গোলাম, আমিরুল মুমেনীন?
হারুন : তুমিই জিজ্ঞেস কর, জবাব নাও।
মেহেরজান : (মুখ ফিরাইয়া) তুমি কে? জবাব দাও। জবাব দিচ্ছে না কেন? (আবার খলিফার দিকে) কে এই গোলাম, জাঁহাপনা? ও জবাব দিচ্ছে না।
হারুন : জবাব আদায় কর।
মেহেরজান : তুমি কে?
[তাতারী নিরুত্তর]
হারুন : এ-কে চেনো না?
মেহেরজান : না।
হারুন : মশ্রুর, হাহ্ হা, মশ্রুর।
[হাসিতে লাগিল। বাধা]
মেহেরজান : হাসি বন্ধ করুন আমিরুল মুমেনীন। কে এই গোলাম?
হারুন : তুমি এ-কে চেনো না?
মেহেরজান : দুনিয়ার তামাম মানুষ কি আমার জানা যে এ-কে চিন্ব?
হারুন : হাহ্ হা।… জিজ্ঞেস কর তোমাকে চেনে কি না।
মেহেরজান : জাঁহাপনা, কয়েদখানার এই অন্ধকারে এই বুঝি আপনার তামাশা? আমি বাইরে চলোম।
হারুন : তা যাও। কিন্তু তার জন্যে সারাজীবন আফসোস করতে হবে।
মেহেরজান : কেন?
হারুন : তুমি ওকে চেনো।
মেহেরজান : চিনি?
হারুন : হাঁ। ওই কোঁকড়া-কঠিন চুলের দিকে তাকাও। গায়ের চামড়া তো আর কালো নেই। চুল ঠিক আছে।
মেহেরজান : তুমি কে কয়েদী? জবাব দাও।
হারুন : হাহ্ হা। চার বছর ধরে আমরা জবাব পাই নি, আর তুমি। এই কয়েক লহমায় উত্তর পাবে।
মেহেরজান : কিন্তু এ কে? আমি চিনতে পারছি নে, জাঁহাপনা।
হারুন : হাহ্ হা। চিনতে পারলে না? গোলাম তাতারীকে আজ চিনতে পারলে না, মেহেরজান?
মেহেরজান : তাতারী… তাতারী… কিন্তু তাতারীর এই দশা কেন?
হারুন : নাফরমান অবাধ্য। তাই–
মেহেরজান : নাফরমান। কি ওর অপরাধ? হারুন : মুখের কথা বন্ধ করেছে। ওকে কি না দিয়েছিলুম। বাগবাগিচা তয়খানা,
বাদী গোলাম ইমার–সব ইকার ঘৃণা করলে। বন্ধ করলে মুখের কথা। তাই চার বছর ধরে, তিলে তিলে শায়েস্তা হচ্ছে–
মেহেরজান : ইন্কার করলে?
হারুন : হ্যাঁ।
মেহেরজান : ইন্কার করলে [একটু অগ্রসর হয়, পরে পেছনে ফিরিয়া]… জাঁহাপনা, যে নাফরমান তাকে কতল করেন নি কেন?