[সকলের প্রস্থান]
২১. নহরে জুবায়দার তীর
নহরে জুবায়দার তীর। বিকাল বেলা। খর্জুরবীথির পাশে একটা টিলার উপর আতাহিয়া ও আবু নওয়াস উপবিষ্ট।
আতাহিয়া : নহরে বাতাসের দোলা লাগছে, দ্যাখো দ্যাখো, নওয়াস।
নওয়াস : নারীর স্নেহ পানি-রূপে এখানে বিগলিত হয়ে ঝরে পড়ছে, আতাহিয়া। আহ্, মানবের প্রেম-মমতা যদি এমনই রূপ পেতো!
আতাহিয়া : কিন্তু তুমি দিন দিন এমন উদাসীন হয়ে যাচ্ছ, আমার আর ভাল লাগছে না, আবু নওয়াস। তুমি আর উচ্ছলিত ঝর্ণা নও।
নওয়াস : আতাহিয়া, সাহারা মশ্রুর অনেক নিচে পৃথিবীর বুক যে-পানি সঞ্চিত রেখেছে–তা কি শান্ত, অনুচ্ছল?
আতাহিয়া : তা নয়।
নওয়াস : মাঝে মাঝে উপরে সব শুকিয়ে ফেলতে হয়, ভেতরে সরস তাজা থাকার জন্যে।
আতাহিয়া : কিন্তু আমি তোমার স্তব্ধতা সইতে পারি নে। উপরিভাগ শুকিয়ে ফেলতে যে অনেক কষ্ট, নওয়াস।
নওয়াস : তা ত হবেই। সকলের কথা তোমার মুখ দিয়ে বলার ভার যে নিয়েছ, বন্ধু। তোমার একার বোঝা ত হালকা। কিন্তু শত-সহস্রের বোঝা যখন তোমার কণ্ঠে চাপে—তখন? কে চায় শুকিয়ে সাহারা হতে? কিন্তু প্রাণধারা সঞ্জীবনের জন্য এই বিশুষ্কতাই মাঝে মাঝে বেছে নিতে হয়।
আতাহিয়া : চলো, কোন সরাইখানায় যাই।
নওয়াস : আমি এখন সরাইখানার দর্শক, শরীকদার নই।
আতাহিয়া : তুমি চলো।
নওয়াস : দর্শনকার আর শরীকদার-রূপেই জীবনকে মেলাতে হয় তবেই জীবনের শতদল ফোটে। চলো।
আতাহিয়া : কি চুপ করে যেয়ো না। তোমার কথাই ত আমি শুনতে চাই।
নওয়াস : তা হলে এই বুকে কান পাতো, মুখের দিকে তাকিয়ো না।
আতাহিয়া : যথাদেশ। তা-ই শুনব বন্ধু। চলো, তার আগে কোন পানশালার ওতে আড়াল হয়ে নিই।
নওয়াস : চলো।
২২. কারাগারের চত্বর
সময়, গোধুলি বেলা। স্থান, কারাগারের চত্বর। হারুনর রশীদ, মশরুরের প্রবেশ। চত্বরের পাশে দণ্ডায়মান তাতারী ও কোড়াদার। তাতারীর হাতে-পায়ে জিঞ্জির। কোড়াদারের হাতে চাবুক। চত্বরের দুই ভাগ। একদিক উঁচু। অন্যদিক কয়েদীর অবস্থানভূমি। সেদিকটা নিচু।
হারুন : তাতারী, তিন দিনের জায়গায় তিন বৎসর কেটে গেল। তোমার জীবনের মেয়াদ বহু দিনদিন বাড়িয়ে দিয়েছি। আজ কিন্তু আমি বোঝাঁপড়া করতে চাই। বাজি ধরে, বন্ধুদের কাছে আমি হেরেছি। কিন্তু আর না…। তোমাকে। আমি শেষ সুযোগ দিতে চাই। জবাব দাও…
[তাতারীর দিকে তাকাল। সে নিশ্চল পাথরের মত দণ্ডায়মান। সমস্ত শরীরে চামড়া নেই বললেই চলে। অবয়ব কিন্তু পূর্বের মতই আছে। নির্যাতনে তা ক্ষয়ে যায় নি। তাতারী অবশ্য পৃথিবীকে আর সম্পূর্ণ দেখে না। দুই স্ফীত ভুরু চোখের উপর ঝুলে পড়েছে। চাবুকের আঘাত-ফল।]
জবাব দাও… আবু নওয়াস বলেছিল, তুমি কালো পাথর। সত্যই তুমি কালো পাথর। তোমার শরীর কি ফুলাদের মত ইস্পাতে গড়া? চাবুকের ঘায়ে তুমি নাকি আর্তনাদ পর্যন্ত করো না। সত্যি কোড়াদার?
কোড়াদার : জাঁহাপনা, বহুদিন আপনার নেমক খেয়েছি। কিন্তু এমন হিমাকাওয়ালা কয়েদী আমি কোনদিন দেখি নি। পিটে পিটে ওকে দুরস্ত করলেও, ও শব্দ করে না, আওয়াজ তোলে না।
হারুন : কি করে?
কোড়াদার : দেখবেন, আলম্পানা?
হারুন : হা, সেই জন্যেই ত এসেছি।
কোড়াদার : তবে দেখুন–
[কোড়া চালায়। অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাতারী শুধু দক্ষ অভিনেতার মত মুখমণ্ডল বিকৃত করে, আর হাঁপায়]
হারুন : খামুস, কোড়াদার আর কি করে?
কোড়াদার : জাঁহাপনা বেহুঁশ হয়ে যায়। কিন্তু তখনও গোঙায় না, আর্তনাদ করে না। জনাব, এ কয়েদী ইন্সান নয়। জীন, দেও বা পাথর।
হারুন : যা কোড়াদার, তুই বাইরে যা। কোড়া মশরুরের হাতে দে। যে হাতে মশ্রুর তলওয়ার চালায়, সেই হাতে আজ কোড়া চালাবে।
কোড়াদার : জো হুজুর, জাঁহাপনা।
[মরুরের হাতে কোড়া-প্রদান এবং প্রস্থান]
মশ্রুর : আলম্পানা, কয়েদীর সমস্ত শরীর থেকে প্রায় খুন ঝরছে, ওর উপর আর কোড় চালানো বৃথা। বেহুঁশ হয়ে যাবে। আর কথা বলা চলবে না–যে জন্যে আপনার এখানে আগমন।
হারুন : বেশ, কোড়া ফেলে দাও। তবে রাখো, দরকার হোতে পারে।–তাতারী, মনে রেখো আজ তোমার কেয়ামৎ। আজরাইলও (যমদূত) আজ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। জবাব দাও–জবাব দাও। বেতমীজ গোলাম তবু স্থির নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। মশ্রুর এই বেতমীজের জিভ টেনে টেনে ছেঁড়ার আয়োজন করতে হয়।
মশ্রুর : তা হোলে কি কথা-বলা সহজ হবে, জাঁহাপনা?
হারুন : হুঁ, মশ্রুর, সেও এক সমস্যা। ইনসানের সঙ্গে লড়া যায় কিন্তু এ ত পাথর–(পায়চারী-রত) গোলাম, তোমাকে শেষ সুযোগ দিলাম। নচেৎ–তারপর মশ্রুর তার কাজ শুরু করবে… জবাব দাও… (তাতারী নির্বিকার। শারীরিক যন্ত্রণায় শুধু মুখ কুঁচকে নিঃশ্বাস নেয় আর ফেলে) না, মশ্রুর–বৃথা কালক্ষেপ।
[হাততালি দিল। দুই জন প্রহরীর প্রবেশ]
প্রহরী : জাঁহাপনা।
হারুন : ওই কামরায় একজন জানানা অপেক্ষা করছে, তাকে নিয়ে আয়।
প্রহরীদ্বয় : আস্সামায়ো তায়াতান।
(প্রস্থান)
হারুন : (অঙ্গুলি নির্দেশ) এক আজব সমস্যা।
মশ্রুর জাঁহাপনা, সমস্যা জইয়ে রেখে লাভ কি? আপনি শুধু হুকুম দিন।
হারুন : মশ্রুর, তার জন্য এত ব্যস্ততা কেন? আমি ভাবছি—
মশ্রুর : আলম্পানা, কি ভাবছেন?