“আরো বলোম, মশ্রুরের সঙ্গে যেতে যেতে”–হঠাৎ সরাইখানার আর এক কোনায়। দেখা গেল, এতক্ষণ ভিড়ে দণ্ডায়মান এক ব্যক্তি প্রথম বক্তার বাক্য সমাপ্তি-মাত্র কথা। বলতে বলতে অগ্রসর হচ্ছে। ভিড় ঠেলে এগোয় সে। মুখে কথা, “বলোম, বগ্দাদের নর-নারীর কান্নায় আমি কাঁদি, তাদের আনন্দে আমি হাসি–তারাই আমার শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনা, শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। তারাই আমার কবিত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের জীবনযাত্রার ধারাই আমার রসের উৎস। মশ্রুর আমার কোন দুঃখ নেই। বগ্দাদের বাসিন্দা আমার ভীরু বুকে সাহস যোগায়। তাদের কথা আমার ঘুমন্ত কথাকে জাগিয়ে তোলে। তাই মৃত্যুতে আমার দুঃখ নেই। কারণ, বগ্দাদের বন্ধুগণ–।”
বক্তা ততক্ষণে অভিনেতা-নওয়াসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সকলে আনন্দে চীঙ্কার দিয়ে ওঠে, “আবু নওয়াস, আবু নওয়াস।”
“বগ্দাদের বন্ধুগণ, তোমাদের ভালবাসায়, তোমাদের কবি আবার তোমাদের মাঝখানে ফিরে এসেছে। আমিরুল মুমেনীন পরে নিভৃতে মশ্রুরকে আমার সামনে বললেন, “একজন নিরীহ কবিকে খুন করে–বগ্দাদবাসীদের আমি কি জবাব দেব? তাই বন্ধুগণ, তোমাদের নিকট, তোমাদের নিঃশ্বাসের উত্তাপে চাঙ্গা আবু নওয়াস এইখানে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যুর পর ফেরেশতা যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি বগ্দাদে না বেহেশতে যেতে চাও? আমি জবাব দেব, বগ্দাদে।”
“আহ্লান সাহলান ইয়া আবু নওয়াস, স্বাগতম, হে আবু নওয়াস”। চারিদিক থেকে রব ওঠে।
“কিন্তু, বন্ধুগণ, সরাইখানা নীরব কেন? জল্লাদের হাতে যদি আমার গর্দান যেতো, তোমরা কি সরাইখানা জমিয়ে তুলতে না? একটি মানুষের মৃত্যু এভাবে দেখা উচিত নয়। আমি ত জীবনের কবি। তোমাদের স্তব্ধ দেখলেই আমার আত্মা বিষণ্ণ হয়ে পড়ত। আকাশের কোন নক্ষত্র খসে গেলে কি অন্যান্য তারা নিজের কর্তব্য ভুলে যায়? রবং সেই শূন্য জায়গা পূরণে এগিয়ে আসে নব উজ্জ্বলতায়।–এসো, সরাইখানা আমরা আজ ভর-পেয়ালা করে তুলি। নতুন গজল শোনাব আমি। আনন্দ কর বগ্দাদবাসী। মওজ-তরঙ্গ তোলো অঙ্গ-সমুদ্রে, চিত্ত অরণ্যে, রুবাব পান্থপঞ্চমে–
সুরে, সুরায়, নৃত্য চঞ্চলতায়, স্বর-মুক্তির স্বচ্ছন্দতায় সরাইখানায় আবার বন্যা ডাকল।
উচ্চ চত্বরে উপবিষ্ট নওয়াস।
আনন্দস্রোত নানা দিক থেকে ওই খানে আছড়ে পড়ছে।
নওয়াসের সম্মুখে পানপাত্র।
কিন্তু তার দুই চোখ বিবাগী। এই প্রাণ-প্রবাহে কি যেন বার বার খুঁজতে লাগল।
২০. আমিরুল মুমেনীনের মহল
আমিরুল মুমেনীনের মহল।
নিশীথ রাত্রি।
–কে?
–মশ্রুর, জাঁহাপনা।
–গোলামকে এনেছো?
–হাঁ, জাঁহাপনা।
–ওকে পৌঁছে দিয়ে, তুমি বাইরে যাও। ওর সঙ্গে আমার কিছু গোপনীয় কথা আছে।
–আস্সামায়ো তায়াতান।
(শৃঙ্খলাবদ্ধ তাতারীর প্রবেশ। সমস্ত শরীর কোড়াঘাতে জর্জর। দেহ প্রায় ত্বকহীন। কপালে, গণ্ডদেশে দগদগে ঘা) তাতারী, জানি, তুমি আমার কথার জবাব দেবে না। কিন্তু আজ খলিফারূপে আমি তোমাকে ডাকি নি।
তাতারী : [কণ্ঠে ঘড়ঘড় শব্দ। শ্বাস-কষ্ট।]
হারুন : আজ তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু-রূপে তোমাকে এইখানে ডেকে এনেছি। তুমি দেখছো, বাইরের বাতাসের কত দাম। আমি তোমার সমস্ত মঙ্গলের জন্য প্রস্তুত। আমাকে ভুল বুঝো না।
তাতারী : (খলিফার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখ স্ফীত। ফলে তাকানো কষ্টকর।]
হারুন : তুমি একটিবার হাসো। তাহলে তুমি যা চাও, তাই পাবে। আমার সুদক্ষ হেকিম রয়েছে, তারা শরীর সাত দিনে আবার পূর্বের মত চাঙ্গা করে তুলবে। তোমার একটা হাসি শুধু প্রয়োজন। জবাব দাও।
তাতারী : [নিরুত্তর]
হারুন : আবু নওয়াসের কাছে আমি অপদস্থ। তুমি নাকি আর কোনদিন হাসবেই না। কিন্তু কেন? কেন তুমি জীবনের পেয়ালা এমনভাবে পায়ে ঠেলে দিচ্ছ? তুমি নওজোয়ান। জীবনের সমস্ত সড়ক তোমার জন্য দু’পাশে ফল-ফুল। নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর তুমি নিজের দুই চোখ যেন অন্ধ করে দিয়েছ। কানে আর শ্রুতিশক্তি রাখো নি। কেন? এই নিশীথ রাত্রি, কেউ শুনবে না। তুমি শুধু জবাব দাও, আমি পাক কোরান ছুঁয়ে কসম করছি—তোমার নালিশের ভিৎ আমি উপড়ে ফেলতে চেষ্টা পাব। তস্বী হাতে কবীর মত আমাকে ভণ্ড মনে করো না আমার কসমের দাম আছে।… তবুও তুমি নিরুত্তর! কি চাও তুমি? একটা গোলামের যা কাম্য, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী, অনেক কিছু তোমাকে দিয়েছিলুম, তুমি নিলে না। এত জুলুম সহ্য করছ, অথচ তোমার কথা যেখানে কাজে পরিণত হতে পারে সঙ্গে সঙ্গে… সেই সুযোগ তুমি নিচ্ছ না। আমি নিজে ভেবে পাই নে। তোমরা কি আর। কোন ধাতুতে গড়া? একটা জবাব দাও…[পায়চারী রত] একটা জবাব… একটা হাসি… আচ্ছা, হাসি জাহান্নামে যাক, একটা জবাব দাও। আমি তোমার সব অপরাধ মাফ করে দেব। যা চাও তাই পাবে। সময় দিলুম … বুঝেছি, তুমি … নির্বাক থাকবে, হাসবে না … বেশ। যাও। তোমাকে তিন দিনের মেয়াদ দিলুম। শুধু একটি হাসি হেসে তুমি জীবনের সবকিছু অধিকার ফিরে পেতে পারো। নচেৎ আরো শাস্তি–হ্যাঁ, শাস্তি–যা কোনদিন তুমি কল্পনাও করো নি। তোমাকে ভেবে দেখার সময় দিলুম।…
(হাততালি প্রদান) মশ্রুর—
মশ্রুর : জাঁহাপনা!
হারুন : মশ্রুর, গোলামকে নিয়ে যাও।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়াতান।
হারুন : মশ্রুর,–না থাক, আর একদিন বলব।