.
নওয়াস : জাঁহাপনা—
আমিরুল : কি নওয়াস?
নওয়াস : জাঁহাপনা, বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন। বুসায়না-হত্যার বিচার আমি এতক্ষণ নিজের চোখে দেখলাম। কিন্তু এতে খুনের কোন প্রমাণ হয় না।
আমিরুল : প্রমাণ হয় না?
নওয়াস : না। এক জনের জান্ ‘হালাক’ (ধ্বংস) করার আগে সমস্ত নিখুঁত প্রমাণ পাওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ জানের মালিক নই। প্রাণ-ধ্বংস সহজ, সৃষ্টি অনেক কঠিন কাজ।
আমিরুল : তুমি কি বলতে চাও?
নওয়াস : এই বিচার ভুল, আলম্পানা।
আমিরুল : কেন ভুল?
নওয়াস : প্রমাণ নেই। কেউ চোখে দেখে নি।
আমিরুল : সব সময় চোখে দেখার প্রয়োজন হয় না। সাক্ষীসাবুদ এবং ঘটনা থেকেই আন্দাজ করা যায়।
নওয়াস : বিচারের ক্ষেত্রে আন্দাজের কোন জায়গা নেই।
আমিরুল : বুসায়না কি আমাখা মারা গেল?
নওয়াস : খামাখা না, আলম্পানা। কিন্তু হাব্সী জওয়ান তাকে খুন করে নি। আর এতো খোদ্কসী–আত্মহত্যার ব্যাপার।
আমিরুল : কিন্তু গোলাম নিজের সাফায়ে একটা কথা পর্যন্ত বললে না, মুখ খুললে না। তা কি অভিযোগ স্বীকার নয়?
নওয়াস : না জাঁহাপনা। আর স্বীকার করলেও ক্ষেত্র অনুযায়ী অনেক সময় খুন স্বীকারকারীর উপর বর্তায় না। বেটার হত্যাপরাধ অনেক সময় কি পিতা নিজের কাঁধে তুলে নেয় না?
আমিরুল : কিন্তু এই গোলাম সব কিছু করতে পারে।
নওয়াস : না, জিল্লুল্লাহ। ও কালো গোলাম কালো পাথর। স্তব্ধ। কালো পাথর কোনদিন নকল হয় না। সাদা আর ঝলমলে পাথরই সহজে নকল করা যায়।
আমিরুল : আবু নওয়াস, তুমি কি বলতে চাও, আমার বিচার ভুল?
নওয়াস : হ্যাঁ, আলম্পানা।
আমিরুল : ভুল? আবু নওয়াস, তোমার জিভ সামলাও।
নওয়াস : জাঁহাপনা, ভুলকে ভুল বলা কবিদের ধর্ম। আমরা শুধু সুন্দরের পূজারী-ই নই।
আমিরুল : আমি ভুল বিচার করি?
নওয়াস : জিল্লুল্লাহ, ইনসান ভুল করে বসে বৈকি। আমরা জানি, আমিরুল মুমেনীন ফেরেশতা নন।
আমিরুল : নওয়াস, চুপ–চুপ! তোমার বেয়াদবি আমি ক্ষমা করব না।
নওয়াস : জাঁহাপনা, আলহাক্কো মোর্রুন–সত্য তিক্ত পদার্থ, তা আপনি জানেন।
আমিরুল : আবু নওয়াস, তুমি হদ্ ছাড়িয়ে যাচ্ছ। আমার কাজী-আমির-ওমরা–এত লোক, যারা প্রতিদিন বিচার করে তারা ত বিচারে কোন ভুল দেখল না।
নওয়াস : জাঁহাপনা, তারা যখন অপনার চোখ দিয়েই দেখে, তখন নিজেদের চোখ ব্যবহার করে না। আর যখন নিজেদের চোখও দেখার কাজে লাগায়, তখন আপনার চোখের ঝিলিক তারা আগেই দেখে নেয়।
আমিরুল : উপস্থিত এত শরীফ মানুষদের তুমি বেইজ্জৎ করছ, আবু নওয়াস।
নওয়াস : না জাঁহাপনা। নওয়াস মদ্যপ। মাতালেরা দুনিয়ার কারো উপর শক্রতা করে না–এক নিজের উপর ছাড়া। কাউকে বেইজ্জৎ করা আমার খলতের বাইরে।
আমিরুল : অর্থাৎ আমার ইন্সাফ ভুল।
নওয়াস : হাঁ, আলম্পানা।
আমিরুল : খামুস্, নওয়াস। তোমার বুকের পাটা আল্লার জমিন ছাপিয়ে যাচ্ছে। বেয়াদব ইনসানকে আমি মাফ করি না। তোমাকেও মাফ করব না। শুধু এক শর্তে, তুমি ক্ষমা পেতে পারো–এই উপস্থিত শরীফ ব্যক্তিদের কাছে যদি মাফ চাও। নচেৎ–
নওয়াস : নওয়াস আপনার দরবারে কোন গুনা করে নি, জাঁহাপনা।
আমিরুল : তুমি মাফ চাও।
নওয়াস : বেকসুর নিরপরাধ কিভাবে ক্ষমা চাইবে?
আমিরুল : মাফ চাও।
নওয়াস : আপনি আমাকে এই কাজ থেকে মাফ করুন।
আমিরুল : নওয়াস, তুমি বেয়াদব নও শুধু। না-ফরমান। গোলামের সঙ্গে তোমারও গর্দান ধূলায় লুটিয়ে পড়ুক–। মশ্রুর–
নওয়াস : জাঁহাপনা, আপনার যা মরজী। কিন্তু জাঁহাপনা মনে রাখবেন, আপনার সাধের বগ্দাদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আজ আমি আমার গর্দান বাড়িয়ে দিলাম কারণ এই বহূদাদকে আমি ভালবাসি, আমার জন্মভূমি বগ্দাদ। ভবিষ্যতের একটি মানুষ অন্ততঃ বলবে, বগ্দাদ অবিচারের কাছে মাথা নোয়ায় নি। জাঁহাপনা—
আমিরুল : মশ্রুর একে আজ কয়েদখানায় রাখো, কাল দরবারে আবার নতুন বিচার হবে এই না-ফরমান, অবাধ্য কবির।
নওয়াস : জাঁহাপনা, একটা কথা বলবার দাবি জানাচ্ছি। বগ্দাদকে আপনি যেমন ভালবাসেন, তেমনি আমিও ভালবাসি। কিন্তু আপনার বগ্দাদের কোন ঐশ্বর্যই টিকবে না। টিকে থাকবে শুধু বগ্দাদের বিবেক এবং বিবেক-সাধনা। ও কেউ ধ্বংস করতে পারে না। ধ্বংসস্তৃপের নিচে পড়ে থাকলেও ওর কণ্ঠধ্বনি অনাগত মানুষ শুনবে–তারা বগ্দাদকে বাঁচিয়ে তুলবে। তাই আজ অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ালুম। যে-বীজ আপনি রোপণ করেছেন, তাই একদিন বগ্দাদকে গ্রাস করবে। তাই আবু নওয়াস আজ বন্ধ সাজল। নিজের হাতে নিজের গর্দানকে গেন্দুয়ার মত ছুঁড়ে ফেলে দিলে যেন বগ্দাদের বিবেক আবার চীৎকার দিয়ে উঠতে পারে, “আমি কবি, চিরন্তনের কণ্ঠস্বর! মরুরের তলওয়ার, আমিরুল মুমেনীনের ভ্রূকুটি-দণ্ড কবির হলকুমের (গ্রীবা) নিকটে পৌঁছাতে পারেনা। বগ্দাদের প্রেম আমাকে বানিয়েছে কবি, বগ্দাদের প্রেম আমাকে করে তোলে শহীদ। কবিরা নিত্যকার শহীদ–কারণ, জীবনকে সব সময় তারা পিছনে ফেলে চলে। জীবন থেকে জীবনান্তর। কবিরা তাই মাত্র একটি বার পুনরুজ্জীবনের স্বর্গলোভী শহীদ নয়। তারা বাঁচে, আবার শহীদ হয়; শহীদ হয়, আবার বেঁচে ওঠে। জীবন-মৃত্যুর সাময়িক ফারাকে তাই তারা বিহ্বল হয় না, শঙ্কাত্রাসে ধূলায় লুটিয়ে পড়ে না। কবিমাত্রই রক্তবীজ, বিবেকের নিষ্কাম সাধক। চলো মশ্রুর। নিয়ে চলো। তোমার তলওয়ারের ধার এতদিন কোন মানুষ স্পর্শ করে নি। এবার অন্ততঃ সে কলঙ্ক থেকে রেহাই পাবে। আদাব, আমিরুল মুমেনীন।”