গরাদের ওপারে তাই ত মানুষ মাথা কোটে। নিপ্ৰাণ পাথরেও চেতনার প্রলেপ আরোপ করে। মেজে-মেজে হৃদয়কে করে তোলে অমলিন নিদাগ আরশি। সেখানে অন্ততঃ পৃথিবীর ছায়া পড়ক।
গরাদের এপার এবং ওপারের দূরত্ব-পার্থক্য মুছে দিতে তাই নবেন্দ্রিয় সৃষ্টি হয়। ধারা বিচ্ছিন্ন উপনদী সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। তরঙ্গ-কল্লোল একক শব্দে কখনও মুক্তি পায় না।
ওইখানে হাব্সী-মুখের দিকে তাকাও। কোড়াহত ও-মুখ কি অনড় স্থৈর্যে অবিকল? না। কৃষ্ণ হাব্সীমুখ সফেদ আরমেনী মুখের আদলে কী ডুবে যাচ্ছে না? আশির সমতল রূপান্তর ধরে রাখছে না শুধু।
তুমি হয়ত দেখতে পাও না। কারণ, তুমি সেই নবন্দ্রিয়ের অধিকারী নও। তার চেয়ে গরাদের প্রাচীরেই কান পাতো। পাষাণেও চেতনা-প্রবাহ আছে। অভিশপ্ত বগ্দাদ এখনও নিদ্রা-সমাহিত। তার ঘুম যেন কেয়ামতের পরও ভাঙবে না।
১৯. সরাইখানার প্রবেশ-পথ
বগ্গাদের এই সরাইখানার প্রবেশ-পথ খুবই সঙ্কীর্ণ। মালিক একটা ছোট গালিচার উপর উপবিষ্ট। পিছনে মোটা গের্দা। সামনে রূপার নল-সংযুক্ত হুক্কা। আনমনা ধূমপান করছিল সে।
কিন্তু এই প্রবেশ-পথ পার হয়ে গেলেই সরায়ের আসল চেহারা দেখা যায়। স্তিমিত আলোয় বিরাট হলের মধ্যে নৈশ-বিলাসীরা বসে আছে। কেউ নিঃসঙ্গ। কেউ দল-বাধা। এখানে কফি-শরাবের মজ্লিশ গুজার। কল-গুঞ্জনের বিভিন্ন গ্রাম সমস্ত কক্ষে নিনাদিত। মৃদু ফিসফিসানি থেকে হাহ্ হা– হৈহো রব, সবই এই জায়গায় সাজে। কোনায় কোনায় নর্তকীদের নাচ, মাঝে মাঝে ঘুঙুর ও তাম্বুরীণের আওয়াজের সঙ্গে হঠাৎ ঢেউ তুলে যায়; তা আছড়ে পড়ে নানা বিভঙ্গে। কেউ শুধু তাকিয়ে দেখে আবার জামে ঠোঁট নামায়, কেউ তালি-সংযোগে চীঙ্কার দিয়ে ওঠে, “মারহাবা, মারহাবা।” যেন কেয়ামৎ হঠাৎ দেখা দিয়ে ত্রস্ত পালিয়ে গেল। পৃথিবী আবার আনন্দে নির্বিবাদ।
অন্যান্য দিনের মত আজও সরাইখানা এতক্ষণ গুজার ছিল। তারপর আওয়াজের তোড় কমে গেছে। কিন্তু কথার সোড় থামছে না। অবিশ্যি লয় মৃদু, খাদ-অভিমুখী।
সরাইখানার মাঝখানে একটি পাথুরে-মাটির ছোট উঁচু চবুতরা। তার উপর এতক্ষণ কয়েক জন বসে বসে কফি পান করছিল। এক জন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলঃ সাবাস, আবু নওয়াস, সাবাস।
তারপর সমস্ত সরাইখানায় ওই একই নাম ঘুরে ঘুরে আসে। আবু নওয়াস। আবু–আবু নওয়াস। আবু নওয়াসের কি হবে?
নতুন কয়েকজন আগন্তুক এসে পড়ল। সরাইয়ের গুহায়। হয়ত এই স্তিমিত ভাবের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। সরাইখানায় কি কেউ আসে গৃহোচিত নীরবতা উপভোগে? সকলের তরঙ্গে গা ঢেলে সবাই স্নানার্থী এইখানে। ম্রিয়মাণতা এখানে নিষিদ্ধ, পাপ।
আগন্তুক একজন সরাইয়ের মাঝামাঝি এসে চিৎকার দিয়ে উঠল : গোটা বগ্দাদ কি আজ মৃত না কোন কেয়ামত খবর পাওয়া গেছে–যার জন্যে সরাইখানা আজ ঠাণ্ডা গোরস্থান?
চারিদিক থেকে চোখ এই চ্যালেঞ্জ-দাতার উপর পড়ল।
প্রথমে অনেকে প্রশ্নটা বুঝতে পারে না। উত্তর-প্রার্থীর উদ্দেশ্য কি? কি জবাব চায় সে?
আবার শোনা গেল কর্কশ কণ্ঠস্বর, “বগ্দাদ কি মৃত না কেয়ামতের প্রতীক্ষার্থী?”
এইবার কয়েকজন কফির পেয়ালা ঠোঁট থেকে নামিয়ে নওজোয়ানের দিকে তাকায়। বিরক্ত হয় অনেকে। সরাইয়ের হাওয়া যেন এই তরুণ আগন্তুক বিষিয়ে দিচ্ছে।
পশ্চিম কোনা থেকে আর এক যুবক দাঁড়িয়ে জবাব দিলে, “আপনি অন্ততঃ বসে পড়ে প্রমাণ দিন যে, আপনি মরেন নি”
–কিন্তু বগ্দাদ মরে গেছে।
–না।
–তবে এই সুম্সাম ভাব কেন?
–বগ্দাদ তার যৌবনের উৎসব পালন করছে। বগ্দাদের নওরোজ আজ।
–নওয়োজ কি এইভাবে পালিত হয়? গোরস্থানের স্তব্ধতায়?
–বগ্দাদ মরে গিয়েছিল। আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে। তাই আমার হুল্লোড়ে মেতে তার পবিত্রতা নষ্ট করতে রাজি নই। আপনার ভাল না লাগে অন্য সরাই দেখুন। বাদে তার অভাব নেই।
–আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি নে।
–বগ্দাদ দুনিয়ার শয়তানদের কাছে একটা ধাঁধা। আর তুমি এত সহজে বুঝে ফেলবে, নওজোয়ান?
–মেহেরবানী করুন, আপনাদের এই প্রহেলিকা আর সহ্য করতে পারছি নে।
–আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে।
–কবে তার মৃত্যু হয়েছিল?
–তার খোঁজ পান নি, টের পান নি?
–ব্যাপার কি, ভাই?
–আজ বগ্দাদ বেঁচে উঠেছে। আপনি তো জানেন, বুসায়না খুনের ইনসাফ হচ্ছিল আজ আমিরুল মুমেনীনের দরবারে। আমির-ওমরাহ-কাজী সবাই বললে, হাব্সী তাতারী এই খুন করেছে। খুন কা বলা খুন। গর্দান নেওয়া হোক হাব্সীর।
তখন সরাইয়ের আর এক কোনায় অন্য দুই নওজোয়ান চিৎকার দিয়ে উঠল, “থামুন–থামুন।” তাদের প্রসারিত করতালু আর আঙুলের দিকে সকলের দৃষ্টি আবার ধাবিত হয়।
“থামুন, থামুন”,রবে দুইজনে এগিয়ে এলো, দুই নওজোয়ান। তারপর তারা বললে, “আজ আমরা দুইজনে দরবারে ছিলাম। সব কথাই মনে আছে। আমাদের একজনকে খলিফা আর একজনকে নওয়াস মনে করলেই আপনারা গোটা দরবার চোখের সামনে দেখতে পাবেন।”
“বেসক-নিশ্চয়-নিশ্চয়,” সমর্থনের রব উঠল চারিদিক থেকে। “এতক্ষণ তো শুনছিলাম, এবার চোখেও দেখতে পাব।” জনান্তিকে একজন প্রস্তাব করলে, “চত্বরটা ছেড়ে দিন। ওখানে খলিফা বসুন। আর নওয়াস নিচে দাঁড়াক। সকলের দেখতে সুবিধা হবে।”
–নিশ্চয়, নিশ্চয়।
প্রস্তাব-মত মঞ্চ সজ্জিত হতে আর বেশি বিলম্ব ঘটে না। তারপরই সরাই দরবারে পরিণত হয়। আগন্তুক দুইজন তখন অভিনেতা।