–মোহাফেজ?
–আমিরুল মুমেনীন, আপনার বান্দা।
হারুন : গোলাম তাতারীর ধবর কী? গোলাম এবার হাসছে?
মোহাফেজ : না জাঁহাপনা।
হারুন : এত দূর হিমাকৎ–আস্পর্ধা!
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, গোলাম চুপচাপই থাকে। আহার প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। সে-খবর দিতে আমি আসি নি।
হারুন : তবে তুমি কি খবর নিয়ে এসেছো?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, বুসায়না আত্মহত্যা করেছে।
হারুন : বুসায়না আত্মহত্যা করেছে!
মোহাফেজ : বাগিচার এক গাছের ডালে ঝুলছিল, আজ বিকেলে দেখা গেল। আমরা কেউ খোঁজই পাইনি।
হারুন : বুসায়না আত্মহত্যা করেছে, না, গোলাম তাকে খুন করেছে?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, সব খবর আমার জানা নেই। কাল রাত্রে তাতারী আমাকে ডেকে বলে, বুসায়না কোথা গেল খোঁজ কর।
হারুন : বুসায়না, রাত্রে গোলামের কাছে ছিল না?
মোহাফেজ : না জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : এখনই কোতোয়ালকে ডাকো। শুনেছো, বুসায়না আত্মহত্যা করেছে।
মশ্রুর : এখনই শুনলাম।
হারুন : যাও, কোতোয়ালকে খুনের তদারক করতে বলে। আমি এখনই বাগিচায় যাব।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান।
হারুন : মোহাফেজ, এতদূর আস্পর্ধা গোলামের। গোলামকে আবার গোলাম বানাব। তার দেহ টুকরো টুকরো করব না। ছিঁড়ে ছিঁড়ে তিলে তিলে পশুপক্ষী পোকার আহার্য বানাব। হাব্সী গোলামের এত সীনার জোর? মোহাফেজ…
মোহাফেজ : জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : গোলাম এই খবর জানে?
মোহাফেজ : আলম্পানা, গোলামের কাছে এই খবর যাওয়া মাত্র সে ত পাগলের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল, তারপর দৌড়ে গেল সেই গাছের নিচে। অন্যান্য গোলামের সাহায্যে গাছ থেকে লাশ নামিয়ে সে ত ছাতিপেটা শুরু করল, আর হাউ হাউ কান্না। জমিনের উপর কি পান খাওয়া। বহেনের জন্যেও ত কেউ এমন করে না।
হারুন : তাজ্জব ব্যাপার। মশ্রুর ফজরে গিয়ে শুনে এসেছিল, বুসায়না নিজের মাকানে ফিরে গেছে। মাকানেও ছিল না।
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, গোলাম বুসায়নার গোসলের ব্যবস্থা করছে।
হারুন : কিন্তু সকালে মশ্রুরকে গোলাম বলেছিল, বুসায়নাকে সে জায়গা দেয় নি ঘরে।
মোহাফেজ : আলম্পানা, আল্লা এর মাজেজার রহস্য জানে।
হারুন : বাগিচায় আর কেউ আছে?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, বগদা, জাঁহাপনা, বগ্দাদে বুসায়নার রূপের খ্যাতি কে না শুনেছে। ধনদৌলতের রোশনাই-ও তার কম নয়। সমস্ত বগ্দাদ আজ বাগিচায় ভেঙে পড়ছে। লাশের পাশে পাগলের মত কাঁদছে আপনার গোলাম তাতারী।
হারুন : মশ্রুর, কোতোয়াল পাঠিয়ে বাগানের ভিড় হটাও। আমি খোদ্ যাব।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই মোহাফেজকে বিদায় দিন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
হারুন : যাও, মোহাফেজ।
মাহাফেজ : আস্সালামা আলায়কুম ইয়া আমিরুল মুমেনীন।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, গোলাম খুন করে ওকে গাছে ঝুলিয়ে দেয় নি ত?
হারুন : নিমকহারামকে দিয়ে কি না সম্ভব! গোলাম একটা পাথরের পিণ্ড ছাড়া আর কি। বুসায়না যে ওর কাছে ছিল না, তাও সত্য। মোহাফেজের জবানী তার প্রমাণ। হয়ত বুসায়না বাজি ধরে হেরে গিয়েছিল। তাই তোমার তলওয়ারের ভয়ে গাছে ঝুলেছে।
মশ্রুর : ওর মাজেরা আলেমুল গায়েবই জানেন।
হারুন : চলো, সরেজমিন তদারক করা যাক। কিন্তু তার আগে মশ্রুর, সেই বান্দীর বাচ্চা, বান্দরের বাচ্চাকে কয়েদখানায় নিয়ে যেতে বলো। একদম ‘হাবিয়া’ কয়েদখানায়। পোকামাকড় বিচ্ছুর সঙ্গেই জিন্দেগানী চলার উপযুক্ত ও একটা কমিনা-কমজাত। নওয়াসের কাছে আমাকে বেইজ্জৎ করে ছাড়ছে। এত বেসুমার মালমারসালিক করে দিলাম। তবু গোলামের বাচ্চা হাসল না। তবে হাসি আমি আদায় করব। যাও, মশ্রুর। আমার প্রতিটি লফ্জ শব্দ যেন ঠিকঠিক পালন হয়।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান।
১৭. আবু নওয়াস হাঁটছিল
আবু নওয়াস হাঁটছিল।
পাশে দজ্লা বয়ে চলেছে। মেঘে গোধূলির ঝিলিমিলি। এখানে শহর থেমে গেছে। বেবহা ময়দানের প্রারম্ভ। মরুভূমির অংশ বিশেষ। তবে এখানে আবাদ আছে। আর আছে খুর্মা গাছের সারি।
নদীর উপর গুফাদারেরা গুফা বেয়ে চলেছে। কোন কোন গুফা বোঝাই তরমুজ, তামাক কফি। সন্ধ্যার আগে ঝাপসা স্তিমিত এই জীবন-লীলার দিকে নওয়াসের কোন লক্ষ্য নেই। বালু-তীর। খালি পায়ে হাঁটার জন্য মনোরম। নওয়াস তাই হাঁটছে। তীরে দজ্লার ঢেউ এসে লাগে, কখনও কখনও নওয়াসের পায়ে আছড়ে পড়ে। কবি একটু চমকায় মাত্র। তারপর হাঁটতে থাকে। কোন কিছুর দিকে তার আকর্ষণ নেই। উটের কাফেলা চলেছে দূরে দূরে। গোধূলির অন্ধকারে খেজুর বীথির পাশে পাশে এই দৃশ্য অবসরভোগীর আশীর্বাদ। কিন্তু নওয়াসের চোখ আজ কোন বস্তুর উপর এককভাবে বিদ্ধ হয় না। দৃষ্টি স্পর্শ করে, গ্রহণ করে না কিছুই।
নওয়াস যেন আজ অনন্তের মুসাফির। তাড়াহুড়া নেই, ক্ষিপ্রতা নেই। আরো–আরো কিছু আছে চোখে দেখার। তাই হঠাৎ একাগ্রতার প্রয়োজন-বোধ লাগে না।
নওয়াস হাঁটছিল। দজ্লা ঈষৎ শান্ত, ঈষৎ নীরব! তবু মানুষের মেহনতের নানা পট তো সাজানো। নওয়াস তা দেখতে প্রস্তুত নয়।
মরুভূমির বুকে কি সে কোন পানশালার খোঁজ পেয়েছে? না, এই বালুর চাঁচর রাজ্যে পানি স্বপ্ন-মাত্র। পাশালা ত বেহেশত।
আর শহরের শ্রেষ্ঠ পান্শালা ত সে ছেড়ে এসেছিল গোধূলির পূর্বে।