আতাহিয়া : কিন্তু তুমি যে শুধু রূপের হাটে ঘুরে বেড়াও।
নওয়াস : রূপের হাট-ই আসল হাট। মানুষ যদি তা না আবিষ্কার করত, এই দুনিয়ার বাঁচার আর কোন মজা থাকত না। ফুল তো বনে ফোটে। কিন্তু তাকে আমরা সাজিয়ে ফোঁটাতে চাই। তাই বাগান করি। রূপের নেশা থেকেই কাজের উৎপত্তি অথবা কাজ থেকে রূপের নেশার উৎপত্তি… আর কাজই সমস্ত সংসারকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমার মত নিষ্কৰ্মারা আকাশের দিকে তাকায়। কাজে আর রূপে মিতালি পাতিয়েই তো ইনসান এগোচ্ছে। যখন আর ওই দুই খোট একত্রে মেলাতে পারে না, তখনই মানুষ হয় ইব্লিশ। মুনাফেকীর (ভণ্ডামি) জন্ম সেইখানে।
আতাহিয়া : কিন্তু নওয়াস, জাহেলী (অজ্ঞতা) থেকেও তো মুনাফেকীর জন্ম হতে পারে।
নওয়াস : তা হয়। কিন্তু জাহেলী তো একটা তাসীর (ফল)। তুমি কেমন মা-বাপ ইয়ার-দোস্ত-মুলুকে মানুষ, তার উপরও অনেকটা নির্ভর করে।
আতাহিয়া : কিন্তু এ আমরা কোথায় যাচ্ছি?
নওয়াস : কেন?
আতাহিয়া : এলাম, দু-দণ্ড মওজ করব। তুমি পান করবে, আমি গান শুনব। সে জায়গায় এসব কি শুরু করলে?
নওয়াস : রুহ্ সাফা (আত্ম-পরিষ্কার) পানি ত তোমার জঠরে যায় না, তাই আমার জায়গাটা তোমার ঠিকানা-মত নয়।
আতাহিয়া : না, ইয়ার। আবার গজল গাও।
নওয়াস : কিন্তু গজল আর জমবে না।
আতাহিয়া : কেন?
নওয়াস : কল্পনার বোরারকে (স্বর্গীয় বাহন) চড়ে, তুমি দুনিয়ার তাবৎ সুলতানার (রানী) সঙ্গে ‘জেনা’ ব্যভিচার করতে পারো, আর এ খাহেশও স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির উপর পড়লে, বিবিরও মত নিতে হয়।
আতাহিয়া : লা-হাওয়া, লা-হাওলা। বাঁচাও প্রভু শয়তান থেকে।
নওয়াস : সত্যি।
আতাহিয়া : কিন্তু আমি বলছি, তোমার কল্পনা যদি ভেঙে থাকে, জোড়া দাও।
নওয়াস : তা আর সম্ভব নয়। দ্যাখো আবুল আতাহিয়া, তুমি আর যাই করো আমার সঙ্গে বাজি ধরো না। খোদ্ আমিরুল মুমেনীন আমার সঙ্গে বাজি ধরে প্রায় হারতে বসছেন।
আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে বাজি?
নওয়াস : তারই ফয়সালা আছে কাল। পরে সব শুনবে। আজ থাক্, চলো ওঠা যাক্।
আতাহিয়া : আবু নওয়াস, বগ্দাদ তোমাকে চেনে না, তাই তোমার এত বদনাম।
নওয়াস : বন্ধু মহাপুরুষদের অনেক দেরীতে চেনা যায়। চল্লিশ বৎসর লেগে গিয়েছিল হয়রত মুহাম্মদ (দঃ) কে জানতে। তাই বলে আমি একটা বিশেষ কিছু… তা মনে করো না। এক দেশে বাদশার নাম ছিল হবু। মন্ত্রীর নাম ছিল গুব। মহাপুরুষেরা নবুয়ৎ (নবীত্ব) পায়, আমি এবার গবুয়ৎ পেয়ে যাব।
আতাহিয়া : হা-হা-হা, আবু নওয়াস। তোমাকে ঠিকমত বুঝি না, তবু বুকে বুক মিলাতে ইচ্ছা করে।
নওয়াস : খবরদার। এর নাম বুৎ-পরস্তি–প্রতিমা পূজা। ও মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ধ্বংসের পথে। বুঝবে, তবে বুকে বুক মিলাবে। সব জিনিস তুমি যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করবে, নচেৎ তুমিও বুৎ-পরস্ত (প্রতিমা পূজক)–সে তুমি মুসলমানই হও আর ইহুদীই হও। না, আর কথা না। ওহে সরাইওয়ালা তোমার শরাবের দাম কাল নিও।
সরাইওয়ালা : আচ্ছা জনাব। আস্সালামো আলায়কুম।
উভয়ে : ওআলায়কুম আসোলাম।
১৫. বেগম জুবায়দা দাঁড়িয়েছিলেন
বেগম জুবায়দা দাঁড়িয়েছিলেন, যেখান থেকে একদিন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল মেহেরজান। বাগানে তেমনই অন্ধকার। সাদা পাথরের রাস্তা হয়ত কিছুটা আভাস দিয়ে যায়। হয়ত মেহেরজান এই পথেই আবার ফিরে আসবে। মালে-গনীমতের মধ্যে এমন উপহার পাওয়া যায়? কথাটা একবার বেগমের মনে জাগল। তিনি পায়চারী করতে লাগলেন।
কালো বোরখা পরিহিতা এক নারী হঠাৎ পেছন থেকে তাকে ডাক দিলে ফিসফিস কণ্ঠে :
–বেগম সাহেবা।
–কে তুতী?
–জী, বেগম সাহেবা।
তুতী মহলের ক্রীতদাসী। বোরখা খুলে ফেলেছে সে ততক্ষণে।
–কোন খবর পেলি?
–না, বেগম সাহেবা। এই বিরাট মহল। যেখানে শত শত গোলাম আর বান্দী, সেখানে খবর পাওয়া মুশকিল।
–আমি ত আর কিছু চাই নে। কেমন আছে, এইটুকু খবর পেলেই খুশি।
–বেগম সাহেবা, আপনি ওকে বড় ভালবাসতেন।
–তা ত বাসতাম। পরের দুঃখ মুছে নিতে পারলে রুহে আত্মায় কত যে শান্তি, তা যদি মানুষ জান্ত।
–বেগম সাহেবা, আপনি ফেরেশতা। বেহেশতের হুর দুনিয়ায় এসেছেন।
–যা, কি-যে সব বলি। পানির জন্য মানুষের কত কষ্ট। আমি একটা নহর কাটাব ঠিক করেছি।
–বেগম সাহেবা, সবাই আল্লার কাছে হাত তুলে আপনার জন্যে দোয়া মাঙবে।
–তুই মেহেরজানের খবর আন্তে পারলি না।
–বেগম সাহেবা, এই মহলের ব্যাপার ত আপনি জানেন। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সকলে যে-যার স্বার্থ নিয়ে আছে। মেহেরজান… এখানে না-ও থাকতে পারে।
–হুঁ। তুই যা। খবরদার, এ-খবর কেউ না জানে।
–খোদার কসম, বেগম সাহেবা। আপনি মায়ের সমান। আমার কাছ থেকে কোন খবর আল্পর ফেরেশতা পর্যন্ত বের করতে পারবে না।
তুতী চলে গেল।
বেগম সাহেবা দাঁড়িয়ে রইলেন খাম্বার মতই অনড়। উত্তর্ণ। বাতাসের ঈষৎ শব্দ তাঁকে উচ্চকিত করে তোলে।
তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি মেহেরজান। তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবেনা। তার একমাত্র দুশমন দুরন্ত যৌবন। সেই যা ভয়। নচেৎ এমন নিভাঁজ অন্ধকারেই ত সে ফিরে আসবে।
বেগম জুবায়দা বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
১৬. মোহাফেজ এবং হারুনর রশীদ
মোহাফেজ এবং হারুনর রশীদ।