তাতারী : তবে?
বুসায়না : সব মাথায় পেতে নেব। কত কালিমা ত সারা জীবন বইলাম। খুনেই তা সাফ হতে পারে। আসুক মশ্রুর, তার জন্য অপেক্ষা করব।
তাতারী : না বুসায়না। জীবন অনেক মূল্যবান। তা-ই আত্মহত্যা করি নি। আত্মহত্যা ভীরু বুজদীলের কাজ। মানুষ জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ায়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে পিছু হটে না। জরা যেমন লেজ গুটিয়ে পালায়, তেমন পালায় না। কিন্তু বুসায়না, তোমার আত্মার সন্ধান আমি পেয়েছি। তুমি এখান থেকে যেয়ো না। আমি কাল ফজরে জবাব দেব, হয়ত মুখ হাসিশূন্য, কি জবাব দেব আমি। মশ্রুর…। একি, বুসায়না কোথায় গেল?… মোহাফেজ… মোহাফেজ…
তাতারী : বুসায়না কোথায় গেল?
মোহাফেজ : এই ত এখানে ছিল।
তাতারী : দ্যাখো, কোথায় গেল। ওর পায়ে ঘুঙুর আছে। যেখানে যাবে, বাবে।
মোহাফেজ : ঘুঙুর? ঐ ত পড়ে আছে গালিচার উপর।
তাতারী : কখন খুললে, আশ্চর্য! যাও, ওর খোঁজ করে আমার কাছে নিয়ে এসো।
মোহাফেজ : যো হুকুম, হুজুর।
১৪. সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল
সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল।
কত দূর থেকে আসে লু-হাওয়ার তীর
সে কি তোমার নিঃশ্বাস সাকী,
আমার কদমে জিঞ্জির
কত আমির তোমার উমেদার
এ দীল সংগেল, বেকারার
সুমসাম রাতে আহাজারী সার,
পাথরে কুটা ফুটা শির।
আমার কদমে জিঞ্জির।।
রুবাবের আওয়াজ শুধু এই স্বরে বিষণ্ণতার আমেজ ছুঁইয়ে যায়। বগ্দাদের সরাইখানার অন্ধকার। গায়ক হয়ত আদেশ দিয়েছিল আলো নিভিয়ে দিতে।
গজল অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে। যেন আজ আর শেষ হবে না। শ্রোতারা বুঁদ। বিরহীর আর্তনাদ সকলের বুকে জারিয়ে গেছে। এখানে সবাই প্রেমিক। ঝাপসা অন্ধকারে শুধু বহু মানুষের আন্দাজ পাওয়া যায়।
হঠাৎ একজন হো হো শব্দে চতুর্দিক সচকিত করে হেসে উঠল।
আসরে ফাটল দেখা দেয়, তাই বহু শ্ৰোতাই বিরক্ত!
সত্যি গায়কের গজল থেমে গেল পরিবেশ মোতাবেক। তার কণ্ঠ থেকে আর রাগ বেরোয় না–যা রাগিণীর পুরুষ রূপ। গোস্বাধৃত তার গলার আওয়াজ।
–আবুল আতাহিয়া, বেয়াদবের মত হাসছো কেন?
–আবু নওয়াস, মাথায় জজমের ঠাণ্ডা পানি ঢালো।
নওয়াস : এমন গজলটা ধরেছিলাম। সব জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলে।
আতাহিয়া : তার মালিক তো স্রেফ আল্লা। আমি তো বান্দা।
নওয়াস : তোমার এমন আক্কেল বলেই তো তেমি কবিতা লেখো।
আতাহিয়া : তোমার আক্কেল আছে, স্মৃতিশক্তি আছে?
নওয়াস : আল্লা মাথার খুলিটা এখনও শূন্য করে নেন নি।
আতাহিয়া : নিয়েছে। টের পাও নি।
নওয়াস : দ্যাখো, এখনই লড়াই বেধে যাবে।
আতাহিয়া : তাতো বাধবেই। নাদানকে নাদান বলেই, তার গলা থেকে গান বেরোয় না।
নওয়াস : আমি নাদান?
আতাহিয়া : প্রায়। পুরো নয়। সেদিন যে বলে, তুমি জীবনের কবি, জীবনের গান গাও; আর আমি মৃত্যুর কবি, নিরাশাবাদী অগয়রহ। আরো কি কি বলে। আজ তুমি কি গজল গাইছ?
নওয়াস : উঃ, আবুল আলাহিয়া। তোমার মাথার খুলিটা হেকিমকে দিয়ে একবার দেখিয়ে নাও। ওটা খালি হয়ে গেছে, টের পাও নি।
আতাহিয়া : এই বুঝি জীবনের গান?
নওয়াস : বিরহে দুঃখ আছে। দুঃখ কি জীবনে আসে না? এতে জীবন-বহির্ভূত কি দেখলে?
আতাহিয়া : মৃত্যু কি জীবনে আসে না?
নওয়াস : আসে। সে একবার মাত্র। তা নিয়ে হাজার বার নাকী কান্না কাঁদতে হবে না কি, তুমি যা করো?
আতাহিয়া : নওয়াস, দুঃখের গান গাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। আজ তুমি যে-বিরহের গান গাইলে এমন মজা আর কোনদিন পাইনি। তোমার কবিতা ফিকে লাগে এর কাছে।
নওয়াস : আবুল আলাহিয়া, ভুল করো না। দুঃখ আর মৃত্যু এক জিনিস নয়। দুঃখের গান গাই দুঃখকে দূর করার জন্যে, দুঃখের মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারব, তার জন্যে। যারা এই জীবন জীইয়ে তুলতে পারে না, তারা কবিতা লেখে শকুনদের জন্যে। পারশীরা শকুনের কাছে যেমন মড়া ফেলে দেয়, ওই কবিরা তেমন কবিতা ছুঁড়ে দেয় পাঠকদের জন্যে। আজান দিয়ে মুসল্লি ডাকে, তুমি কবিতা দিয়ে মানুষ ডাকার বন্দোবস্ত করো। তুমি—
আতাহিয়া : থামো, থামো। এলাম দু-দণ্ড মওজ করতে, তুমি কি যে ক ক শুরু করে দিলে। তৌবাস্তগ্ফেরুল্লা।
নওয়াস: শয়তান তোমার কাছাকাছি থাকে কি না, তাই তোমার বার বার আস্তাগফেরুল্লা পড়তে হয়।
আতাহিয়া : হাহ্ হা, আমি তো শয়তানের কাছেই বসে আছি, ঠিক বলেছো।
নওয়াস : শয়তানই বিশ্বসৃষ্টির আগে প্রথম ন্যায়শাস্ত্রের প্রয়োগসাধন করেছিল। সেই যুক্তিই মানুষের সভ্যতার উন্নতির অন্যতম বড় উপাদান। মনে রেখো আবুল আতাহিয়া। মাঝে মাঝে শয়তানেই হয়তো আসল মনুষ্যত্বের সূচনা ঘটে।
আতাহিয়া : শয়তানের যুক্তি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।
নওয়াস : আতাহিয়া, যুক্তির পেছনে কি থাকে জানো?
আতাহিয়া : না।
নওয়াস : তা তোমার জানার কথা নয়। যুক্তির পেছনে থাকে মুক্তির স্বপ্ন। এই মুক্তির স্বপ্নই মানুষকে মানুষ বানায়। আমি তাই দুনিয়ার তামাসা ভাল করে দেখি।
আতাহিয়া : নওয়াস, তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা দায়। কারণ, চোর আর ছেনাল কারচুপিতে খুব দড়।
নওয়াস : আতাহিয়া, আজ কষে গালাগাল দাও। আমি আজ মজে আছি। আমার আর এক মজুলিশ বাকী আছে।
আতাহিয়া : তোমার সঙ্গে আজ রাত কাটাচ্ছি না।
নওয়াস : নীরস তুমি। মওজ দেখলে তোমার দীল বাতাসে কাঁপে। কিন্তু বন্ধু, জীবনকে খুঁজে পেতে হাটে হাটে ঘুরতে হয়।