বুসায়না : জনাব, এগিয়ে আসুন। নতজানু এক নারী আপনাকে আহ্বান দিচ্ছে। আমার এই যৌবন–কে আপনি বেইজ্জাৎ করবেন না।
তাতারী : বুসায়না, তুমি ত মোড়-জানু। অঙ্গসন্ধিক্ষণে আনন্দ-আহরণ আমার কাছে অজ্ঞাত কিছু নয়–জন্তুদের কাছেও না। আমি মানুষ। আমার মন প্রয়োজন হয়!
বুসায়না : সে-মন এখন প্রয়োজন নয় কেন?
তাতারী : বুসায়না, সময়-ও মানুষের সৃষ্টি। মানুষ আছে বলেই সময় আছে। সময়েরও প্রয়োজন হয়।
বুসায়না : সে-সময় এখন নয়?
তাতারী : না। তোমার খোলা বুক ওড়নায় ঢাকো। নারীর বিবসনা হওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে কেবল প্রেমে। নারীর নির্লজ্জ হওয়ার অধিকার আছে। তা-ও শুধু প্রেমে। একটি মানুষ যার সান্নিধ্যে তার অস্তিত্ব অর্থবান হয়–তেমন মানুষের জন্যে। জমিন-দরদী দেহকান (চাষী) যেমন নহরের পানি নিজের জমির জন্য বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখে, প্রেমিক-নারী তেমনই সমস্ত লজ্জা-সঙ্কোচ একটি হৃদয়ের জন্য সঞ্চিত রাখে। তোমার দেহের দিকে তাকাও। ও ত সওদাগরের দোকান, লেবাস আর জেরে (অলঙ্কার) ঠাসা। দীরহাম দিলেই পাওয়া যায়। নারীর মূল্য অত সস্তা নয়। যে নারী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব-জাতির শিশুকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ দিয়ে আনে, যে নারী শাশ্বত মানবতার জননী বসুন্ধরার অনন্ত অঙ্গীকার, সে অত সস্তা হয় না, বুসায়না। তুমি ভুল ঠিকানায় এসেছে। যারা তোমাকে পাঠিয়েছে, তারাও পৃথিবীর ঠিকানা জানে না।
বুসায়না : আমাকে আপনি বেইজ্জৎ করবেন না।
তাতারী : না বুসায়না। প্রতিদিন কিছু দীরহাম ছুঁড়ে ফেলে, যারা তোমাকে বেইজ্জৎ করে আমি তাদের মত তোমাদের অসম্মান করতে শিখিনি। আমি গোলাম। দীরহাম দিয়ে সব কিছু কেনার পাগলামি থেকে অন্তত আল্লা আমাকে রেহাই দিয়েছেন।
বুসায়না : না, জনাব। আপনি গোলাম নন! অতীতের কথা ভুলে যান। আপনি আমাকে ইজ্জৎ-আই দিয়েছেন। কিন্তু তোর বদৌলত…
তাতারী : কাঁদছো কেন, বুসায়না। কারো চোখের পানি আর সে পানি যদি শিশু কি আওরতের হয়, আমিসহ্য করতে পারি না। কাঁদছো কেন?
বুসায়না : জনাব…
তাতারী : কি বলো।
বুসায়না : জনাব, বুসায়নার পায়ের তলায় বগ্দাদের আমির-ওমরাদের ফরজন্দ্রা কত চোখের পানি ফেলে যায়। দরবারের ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, বৃদবা, লোভে থকা, বিবি-ক্লান্ত কত আমির রঈস বুসায়নার পয়জারে হাঁফ ছাড়তে আসে–সেই রোক্কাসা আজ কাঁদছি না, হাছি।
তাতারী : কিন্তু হাসি তোমাকে প্রতারণা করছে।
বুসায়না : কাঁদছি। হ্যাঁ, কাঁদছি। কারণ এই বয়সে ধন-দৌলতের আলবুরুজ পাহাড়ে উঠে, কেউ মৃত্যু চোখে দেখতে চায় না।
তাতারী : মৃত্যু?
বুসায়না : যা, মৃত্যু। কাল ফজরে, আপনার বাগিচায় আমি কতল হয়ে যাব। মশরুরের তলওয়ারের তেজ একটি নারীর হকুম (গ্রীবা) ছেদে অপারগ তা উন্মাদিও বিশ্বাস করবে না।
তাতারী : কিন্তু মশ্রুর তোমাকে কতল করবে কেন?
বুসায়না : খলিফার হুকুম। আমিরুল মুমেনীন বলেছেন, আমি যদি আপনার খেদমত করতে না পারি, ফজরে আমার গর্দান যাবে।
তাতারী : তুমি এই বাজি ধরলে কেন?
বুসায়না : আত্মবিশ্বাস ছিল। সমস্ত বগ্দাদ আজ লোভের দরিয়া। এখানে কে শুষ্ক থাকতে পারে? শান্শওক্ত, দব্দবা তারই শিকার সমস্ত মানুষ। তারা কোনদিন মানুষ ছিল ভুলে গেছে। আমি ত বগ্দাদের বাসিন্দা। আমি আর নতুন কি হবে? তাই আত্মবিশ্বাস ছিল। আর থাকবে না বা কেন? কত আমির-ওমর দেলাম। কাঁচা দীরহাম আর কাঁচা গোশতের খরিদ্দার। কতজনকে ফতে করলাম। তার জন্য ইলেম লাগে না, সাধনা লাগে না—একটু হাসি, একটু লেবাস এদিক-ওদিক। ধন-দৌলত বিনা মেহনতে আসে। এখানেও বিনা মেহনৎ। শুধু জয় আর জয়। বাজি ধরেছিলাম। হেরে গেছি। কাফ্ফারা (প্রায়শ্চিত্ত) দেব বৈকি। আর কাঁদব না।
তাতারী : কিন্তু আমি তোমাকে মরতে দেব না।
বুসায়না : কেন?
তাতারী : তুমি মহিয়সী নারী। হয়ত বাচার খাতিরে বগ্দাদের ঐ দরিয়ায় ডুব দিয়েছিলে। কিন্তু সামান্য ভাসমান কাঠের টুকরো দেখে তুমি মাটির মানুষ, ডাঙায় ওঠার চেষ্টা পাচ্ছো। তোমাকে মরতে দেওয়া পাপ।
বুসায়না : কিন্তু কে আমাকে বাঁচাবে? আপনাকে আর বেইজ্জৎ করতে পারব না।
তাতারী : সেইজন্যেই ত সোজা উপায় পেয়ে গেছি।
বুসায়না : সোজা?
তাতারী : হ্যাঁ, বুসায়না, তুমিও আমার মত আত্মার ব্যাধিগ্রস্ত। ঐ দেওয়ালে তলওয়ার লট্কানো–আমাকে কতল করো। এ জায়গা আমার কাছে অসহ্য, শ্বাসরোধী।
বুসায়না : তাহলে পালিয়ে যান না কেন? আপনি ত গোলাম নন।
তাতারী : বাহ হা, বুসায়না। এই ধন-দৌলত দেখে সেই রাতে ভুলে ছিলাম। পরে সব বুঝে ভাবলাম পালাই! বাদ মাগরেব শহরের ফটক থেকে বেরুতে যাব, দেখলাম শাস্ত্রী। বলে, এই শহরের বাইরে যেতে পারবেন না, খলিফার হুকুম। আমি কেমন স্বাধীন, বুঝেছো বুসায়না? এই বান্দী বান্দা মুজ্রানী ইমারতের মধ্যে আমি স্বাধীন। একটা মোরগকে কতগুলো মুরগীর সঙ্গে খুল্লার মধ্যে রেখে দেওয়ার মত। তোমার মেহেরবানী আমি কেয়ামত তক্, রোজ হাশরের দিন পর্যন্ত ভুতে পারব না। আমাকে কতল করো। এই নাও তলওয়ার।
বুসায়না : না বেরাদর, আপনাকে মরতে দিতে পারব না। বগ্দাদের সাহারার মধ্যে এই একটি ওয়েসীস আমি পেয়েছি, তা নাস্তানাবুদ করতে পারব না।