তাতারী : জাঁহাপনা…
হারুন : বুঝেছি। তুমি হাসবে না। তুমি আমাকে বন্ধুদের সামনে বেইজ্জৎ করতে চাও। মশ্রুর…
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই নাফরমান বান্দার গর্দান এখনই দু-টুকরা করি।
আতাহিয়া : জাঁহাপনা…
হারুন : কি আবুল আতাহিয়া, তুমি আবার কি বলতে চাও।
আতাহিয়া : জিল্লুল্লাহ্ এখনই ওর সাজা দেবেন না?
হারুন : কেন?
আতাহিয়া : আলম্পানা, কারণ এত খানাপিনা আর গান-বাজনা আর হাসির পর, একদা-গোলামের হাসি না শুন্লেও চলবে।
হারুন : আতাহিয়া, তুমি চুপ করো। মশ্রুর—
মশ্রুর : জাঁহাপনা—
হারুন : তল্ওয়ার খোলো। দেরী করছ কেন?
নওয়াস : আলম্পানা, আলম্পানা… আমি কবি আপনি জানেন। নাফরমানের গর্দান নেওয়া উচিত। কিন্তু এর অপরাধ কতটুকু বিচার করে দেখা হোক। ও হাসছে না। কিন্তু হাসির জন্য ওয়াক্ত লাগে, যেমন নামাজের জন্য প্রয়োজন হয়।
হারুন : আবু নওয়াস, তোমার কবিত্বের খোমা এখন গাছে ঝুলিয়ে রাখো। ওয়াক্ত লাগে? সময় লাগে?
আতাহিয়া : হাঁ, জাঁহাপনা। সব সময় হাসি আসে না।
নওয়াস : আমি ত আপনাকে, নুরুল্লাহ্ আগেই বলেছি, উপাদান লাগে।
হারুন : আবু নওয়াস, তুমি হুঁশে আছে তা হলে।
নওয়াস : আলম্পানা, হুঁশে থাকার জন্যই আমি বেহুঁশ হই। আল্ খামারো লী কামারান্। সুরা আমার কাছে আকাশের চাঁদ।
হারুন : কি বলতে চাও তুমি, আবু নওয়াস? সাফ্-সাফ্ বলো।
নওয়াস : আস্সামায়ো তায়তান। হুজুর দুনিয়ায় কত দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুন-খারাবি, ঝগড়া-কোন্দল, লোভ মোহ মাৎসর্য। এ সব কি দেখা যায় চোখে? বেহুঁশ থাকাই লাভ। আমার ওই হুঁশ আছে বলেই আমি বেহুঁশ থাকতে চাই। আর যাদের সে হুঁশ নেই অর্থাৎ যারা বেহুঁশ–তারা হুঁশে থাকে, আর যারা ইশে থাকে তারা বেহুঁশ। দুনিয়ার তাবৎ লড়াইবাজ দাঙ্গাবাজ ফেরেব্বাজ আওরতবাজ ঘোড়াবাজ মরদ্বাজ নিজেদের ভয়ানক হুশিয়ার মনে করে।
হারুন : নওয়াস, তুমি যে কী বলছ, আমার ও বোঝার সাধ্য নেই। মরদবাজ আবার কি? আরগুলো থোড়াবহুৎ বুঝি।
নওয়াস : আলম্পানা, সেই লুৎ-আলয়হেস্ সালামের জমানায়–
[সকলে : হা-হ্ হা-হ্ হা। হা হ্ হাহ্ হা হ্]
হারুন : আবুল আলাহিয়া, তোমাদের মত কবি এবং বাদক সঙ্গে থাকলে আর খেলাফৎ চলবে না। মশ্রুর, তোমার তলওয়ার নামাও। কিন্তু মনে রেখো, তাতারী তোমাকে যা দিয়েছি, তা আর কেউ পেলে আবার আমার গোলাম হতে চাইত। এত বাগবাগিচা বান্দী গোলাম ধনদৌলত। খবরদার আর নেমকহারামির অপবাদ নিজের মাথায় ঢালবে না। আজ তোমাকে মাফ করলাম। কয়েকদিন পর আবার আসছি, তোমার হাসি আমরা শুনব। মনে রেখো…।
১৩. মজকুর জায়গা পরিচিত বাগিচা
কাল রাত্রি। মজকুর জায়গা পরিচিত বাগিচা। ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা গেল। অনেকক্ষণ। হয়ত কয়েক শতাব্দী। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে সময়ের পাখনা ছিঁড়ে যায়। শতাব্দী মুহূর্তের মধ্যে গুহায়িত হয়।
ঘুঙুরের আওয়াজ থেমে গেল। তারপর রুম্ঝুম্ রিনিঠিনি রব ওঠে। সে শুধু পা ফেলার অনুষঙ্গ হিসেবে। যে-পায়ে ঘুঙুর এতক্ষণ মুখর ছিল, সেই যুগল চরণ এখন হাঁটার কাজে নিয়োজিত।
রুমঝুম… রুমঝুম…রিনিঠিনি…হঠাৎ সেই শব্দও নির্বাপিত।
তাতারী হঠাৎ চকিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলে, “তুমি কে… তুমি কে? কে তোমাকে এখানে পাঠালে?”
–জনাব তাতারী, বান্দীকে মাফ করবেন। আমার নাম বুসায়না। আমাকে আমিরুল মুমেনীন পাঠিয়েছেন।
তাতারী : তুমি কে?
বুসায়না : আমার নাম বগ্দাদে জানে না, এমন ইন্সান ত কম আছে। আমি রোক্কাসা (নর্তকী) বুসায়না।
তাতারী : কি চাও?
বুসায়না : খলিফার হুকুম, আমি যেন আপনার খেদমৎ করতে পারি।
তাতারী : বুসায়না, খেদমতের জন্যে এখানে বান্দা-বান্দী আছে।
বুসায়না : কিন্তু তারা আপনাকে আনন্দ দিতে পারে না। আপনার মুখের হাসি কে যেন কেড়ে নিয়েছে। আমি এসেছি আপনার মুখে হাসি ফিরিয়ে দিতে।
তাতারী : বুসায়না, তাই কী তোমার এই লেবাস?
বুসায়না : কি দেখলেন, জনাব?
তাতারী : লেবাস দেহ-আবরণের জন্য। তোমার লেবাস দেহ উলঙ্গার্থে। এর সাহায্যে তুমি আমাকে আনন্দ দেবে?
বুসায়না : জনাব, রোক্কাসা আপনাকে জাগিয়ে তুলবে।
তাতারী : তার চেয়ে তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যাও বুসায়না, তোমার মেহেরবানী কোনদিন ভুলতে পারব না। আমার চোখে ঘুম নেই। ঘুমের ঘোরে থাকি। কিন্তু শিরা-উপশিরা বিশ্রাম নিতে পারে না। কন্টক-মুকুট মাথায় হজরত ঈসা, যীশুখ্রীষ্ট অমর। আমার কণ্টক-শয্যা আমাকে কি দেবে?
বুসায়না : খলিফা সেই জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনার কালো ঠোঁট বর্ষার কালো মেঘের মত। ও তে চুম্বনের বিদ্যুৎ-ই শুধু শোভা পায়।
তাতারী : না। সরে যাও, বুসায়না। তুমি আমাকে বেইজ্জং করতে এগিয়ে না।
বুসায়না : বান্দীর গোনা মাফ করবেন, জনাব।
তাতারী : তুমি আমার পাশ থেকে সরে ঐ দিওয়ানে বসো।
বুসায়না : কেন?
তাতারী : তুমি আমাকে আনন্দ দিতে পারকে না।
বুসায়না : সমস্ত বাদ শহরে বুসায়নার পায়ে মাথা লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত। আর আপনার মুখে এই কথা?
তাতারী : আনন্দের উপকরণ তোমার কাছে নেই।
বুসায়না : কেন নেই?
তাতারী : মানবীর যৌবনই কি যথেষ্ট? তাহলে জননী-রূপে সে কিরূপে মর্যাদা পায়? ও কি! তোমার সদৃরিয়া খুলে ফেলছ কেন? জানো, জননীর খোলা স্তন বহুদিন আমি পান করেছি। বুঝলাম, তোমার তূণে আদিম কয়েকটা শর আছে মাত্র।