আতাহিয়া : আহ, আবু নওয়াস। আর একটু হেসে নিতে দাও। পেটে কুলুপ লেগে গেল।… আমিরুল মুমেনীন আজকাল হাসির সওদাগরি করেন না কি?
নওয়াস : তুমি জানো না?
আতাহিয়া : না।
নওয়াস : হাসির অনেক দাম। লাখ দীরহামের-ও বেশি।
আতাহিয়া : সত্যি?
নওয়াস : কাল তিনি তোমাকে আমার মারফৎ দাওয়া দিয়েছেন। গোলামের হাসি শুনতে যাবো। আবু ইস্হাক থাকবে। খানাপিনা গান বাজনা সব আছে।
আতাহিয়া : আলহাম্দোলিল্লাহ্।
নওয়াস : চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। সরাইখানা বন্ধ। সড়কে লোজন কম। তার উপর অন্ধকার।
আতাহিয়া : তোমার ভয় কী? তোমার ত তিনকা আছে।
দুই কবি হেসে উঠল জনশূন্য সড়কের উপর। প্রতিধ্বনি দূরে দূরে সহজে অস্তিত্ব হারায় না।
নিদ্রিত মহানগরী বগ্দাদ।
তার দুই কবি শুধু জেগে ছিল।
জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কবিতা কি কখনও বিশ্রাম নিতে পারে?
১১. বেগম জুবায়দা
বেগম জুবায়দা, আপনার পাঁজর কি রিক্ত? নৈশ হাহাশ্বাসের মুখে দজ্লার উপরের দিকে চেয়ে, প্রতীক্ষার দুর্ভেদ্য অরণ্যে পদধ্বনি শুনে কোন লাভ নেই। বক্ষে বক্ষ, সীনা-ব সীনার সাধনা সন্ন্যাসিনী জানে না। তাই তারা কৃচ্ছ্র আর আত্মনিগ্রহের জোয়ালে প্রতারিত যৌবনের আরশীতে বিবেকের প্রতিফলন দেখতে চায়। বিকৃত ইচ্ছা তাদের কাছেই আনন্দের মরীচিকা। গতিহীনতার দুর্গদ্ধ, স্বর্গীয় সৌরভ মনে হয় নাসিকার নিঃসাড় সড়কে। মেহেরজান আপনার কাছে ফিরে আসবে না হৃদয়ে উত্তাপ দিতে। না-ই আসুক। আপনার তৃষ্ণার্ত দুই চোখ আআর সোপান গড়ে তুলুক কল্পনায়। কল্পনা ত মিথ্যা হয়ে যায় না। মহাকাল তাকেই বরণ করে। নির্জনতা-বিহারী মেহেরজান, নাই বা এলো কোলাহলের জোয়ারের মত। বিশাল আকাশ। তাই ত নক্ষত্রেরা নিঃসঙ্গ। আপনার প্রাণের অসীমতায় শুধু দুটি শুকতারা জেগে থাক্।
আদাব, বেগম সাহেবা।
১২. তাতারীর বাগিচা
তাতারীর বাগিচা।
কার্পেট-শোভিত কক্ষ। বিশেষভাবে আজ আলোকসজ্জার পরিপাটী দেখা যায়। চার কোণে চারটি সামাদান জ্বলছে। উপরে ঝাড়বাতি। তাকিয়া, গেদা চারিদিকে সাজানো। কক্ষের দক্ষিণ দিকে সংলগ্ন একটি বারান্দা।
তাতারী কক্ষের ভেতরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার পরিধানে পাজামা পিরহান।
বাগান থেকে ফুলের পোশর এই কামরা পর্যন্ত ধাওয়া করে। তবু মাঝে মাঝে দ্রাক্ষারস সৌরভের কাছে পেছিয়ে যেতে হয়। তিন-চারজন সাকী জাম ও পেয়ালা হাতে প্রতীক্ষমান।
হারুন : তাতারী!
তাতারী : আলম্পানা।
হারুন : ওখানে কেন? আজ আমরা তোমার মেহমান। এই দ্যাখো, কত শরীফ মানুষ এসেছে তোমার বাগিচায়। আবু নওয়াস, আবুল আলাহিয়া, আবু ইস্হাক। এদের যেমন দরবারে তেমনি নিজের মাকানে পাওয়া নসীবের কথা। তুমি ভুলে যাও না কেন তুমি আর গোলাম নও। এসো, এসো।
তাতারী : জাঁহাপনা…
হারুন : খানাপিনা যথেষ্ট হয়েছে। আবু নওয়াস আর মাটিতে পা ফেল্বে না। কি বলো, আতাহিয়া?
আতাহিয়া : জাঁহাপনা, আবু নওয়াস সব সময় মাথায় হাঁটে। ও আর কখনই বা পা ব্যবহার করে?
হারুন : কিন্তু আজ কদম টলটলমান।
আতাহিয়া : জাঁহাপনা, ওর খোয়ারী এসে গেছে। এই নওয়াস!
নওয়াস : জী।
আতাহিয়া : ঘুমোচ্ছ কেন? হাসি শুনবে না?
নওয়াস : আতাহিয়া, তুমি আমার লেজ ছাড়া আর কিছু নও। কিন্তু দুম্বার লেজ বেজায় ভারী।
আতাহিয়া : আমিরুল মুমেনীন, আপনি সাক্ষী থাকুন। নিজের মুখে স্বীকার করেছে, আবু নওয়াস একটা দুম্বা।
নওয়াস : আতাহিয়া, হুজুরের সামনে বেয়াদবি করো না। তুমি তা হলে মেনে নিচ্ছো, তুমি একটা লেজ।
আতাহিয়া : তুমি দুম্বা হলে, আমার লেজ হতে আপত্তি নেই।
নওয়াস : দু……বা… লেজ। দুম্বা লেজ।
আতাহিয়া : আবু নওয়াস, তোমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
হারুন : থামো দুই জনে। তোমাদের কবিদের সঙ্গ মাঝে মাঝে আমাকে ভয়ানক বিরক্ত করে তোলে। খালি কথা আর কথা। তাতারী, এরা এসেছে তোমার হাসি শুনতে। একবার সেই হাসি–বিশ্বজয়ী হাসি–শুনিয়ে দাও ত। এই নওয়াস…
নওয়াস : জাঁহাপনা।
হারুন : চোখ খোলো।
নওয়াস : আস্সামোয়া তায়তান।
হারুন : হ্যাঁ, তাতারী, তোমার হাসি শুনিয়ে দাও। কী…? এখানে লজ্জা পাচ্ছো। ঐ বারান্দায় গিয়েই হাসি শুনিয়ে দাও।
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : কী বলো।
তাতারী : হাসতে পারছি না, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : তুমি কি আবু নওয়াসের মত পানিতে ডুবে আছো?
তাতারী : না, জাঁহাপনা। আপনি দেখেছেন, ও পানি আমি স্পর্শ করি না।
হারুন : তবে হাসবে না যে।
তাতারী : আলম্পানা, হাসি আসছে না।
হারুন : আবু ইস্হাক, একে হাসির দাওয়াই দাও।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, ও এখনি হাসবে। এ-ই হাসো ত হে।
তাতারী : হাসতে পারছি না, জনাব আবু ইস্হাক।
হারুন : আমি খোদ আমিরুল মুমেনীন হুকুম দিচ্ছি, তুমি হাসো। তোমার হাসি আমরা শুনতে চাই। হাসি শোনার জন্যে এদের ডেকে এনেছি। বেইজ্জৎ হব?
সময়ের ভারের কাছে হিমালয় পরাজয় স্বীকার করে। এখানে মহাজাল স্বয়ং অনড়। সকলের নিঃশ্বাস ভারী। কামরায় সকলে নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি একজনের দুই ঠোঁটের উপর নিবদ্ধ। কাল হয়তো এখানেই থেমে থাকত, যদি না হারুনর রশীদ হঠাৎ গর্জে উঠতেন।
হারুন : হাসোর… কি এখনও হাসছো না?
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : আমাকে বহু মানুষ জাঁহাপনা বলে, তোমার কাছ থেকে ও ডাক শুনতে চাই না। আমি শুনতে চাই হাসি।