মেহেরজান : না, আলম্পানা।
হারুন : অমন নতজানু করজোড়ে তোর থাকার দরকার নেই। উঠে দাঁড়া।
মেহেরজান : জাঁহাপনা। বান্দীকে আর গোনাগার করবেন না।
হারুন : আমি যা বলি, তা শোন্। এখানে মশ্রুর খাড়া আছে তা ভুলে যাস্ নি। উঠে দাঁড়া।
মশ্রুর : জাঁহাপনা–
হারুন : গোলাম, তোর আস্পর্ধা আসমান ছাড়িয়ে গেছে। কুকুরের মত তোদের জিভ ছিঁড়ে নিলে তবে গায়ের ঝাল মেটে।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দা গোনাগার। আপনার যা মরজী, তা-ই করুন। বান্দার কোন দুঃখ নেই।
হারুন : আবু ইস্হাক, এ গোলাম ত চমৎকার কথা বলে। ঠিক তোমার মত।
ইস্হাক : হ্যাঁ, আলম্পানা। যারা ভাল কথা বলতে পারে, তারা ভাল হাসতে-ও পারে।
হারুন : কেন, আবু ইস্হাক?
ইস্হাক : আলম্পানা, সাধারণ কথা নয়, ভাল কথার মূল কি? ভাল কথা হচ্ছে রুহের (আত্মার) প্রতিধ্বনি–সেখানেই জমে থাকে, তারপর ঝর্নার মত বেরোয়। অনাবিল হাসি হচ্ছে ভাল কথারই শারীরিক রূপ। তাই জিল্লুল্লাহ, যারা ভাল কথা বল্তে পারে, তারা ভাল হাসতেও পারে। হাসি আর কথার মূল উৎস এক জায়গায়।
হারুন : ও আবু ইস্হাক, তুমি ফল্সাফা-দর্শন শুরু করে দিলে। এত বোঝার মত ধৈর্য এখন আমার নেই। এই বাঁদী–তোর কিছু বলার আছে?
তাতারী : না, জাঁহাপনা। গোনাগার, নাফরমান–আমাদের কতল করুন।
হারুন : মশ্রুর, তৈরি হও। আমার ফরমান মোতাবেক এদের শাস্তি দেবে। এক চুল না এদিক-ওদিক হয়।
মশ্রুর : যো হুকুম আলম্পানা।
হারুন : হাজেরান (সমবেত), মজ্লিস–মশ্রুর, কবি আবু ইস্হাক এবং কোতোয়ালগণ, এই দুই বান্দা এবং বান্দী কানুনের খেলাপ যে কাজ করেছে, তার জন্য এদের শাস্তি কী? তলওয়ারে গর্দান গ্রহণ করা যায়, অঙ্গচ্ছেদ করা চলে, একদিকের পাঁজর নামিয়ে নেওয়া চলে। কিন্তু তলওয়ারের আরো শক্তি আছে। তলওয়ারে লোহার জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারে। আমি এই মজলিসে ঘোষণা করছি–আজ থেকে এই দুই বান্দা-বান্দীর গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন হোক। এ দুই জনে মুক্ত–আজাদ, আমার রাজত্বের দুই জন স্বাধীন নাগরিক।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
তাতারী : হে আমিরুল মুমেনীন, আপনার মেহেরবানী সীমাহীন, আপনার হৃদয় বিশাল, আমরা উভয়ে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। হে জিল্লুল্লাহ, আপনার দুই বাহুতে আরো শক্তি সঞ্চিত হোক যেন সিকান্দার শা’র মত আপনি পৃথিবীর অধীশ্বর হন। আমিরুল মুমেনীন জিন্দাবাদ।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
হারুন : আমি আরো ঘোষণা করছি, এই মুহূর্ত থেকে হাব্সী তাতারী–কয়েক মুহূর্ত আগে যে গোলাম ছিল, বগ্দাদ শহরে পশ্চিমে আমার যে বাগিচা আছে সেই বাগিচা এবং তার যাবতীয় গোলাম বান্দী, মালমাত্তা, আসবাব সব কিছুর সে মালিক। তার সমস্ত লেবাস ও দিনগুজরানের খরচ আজ থেকে খাজাঞ্চীখানা বহন করবে।
[সকলে : মারহাবা। মারহাবা।]
তাতারী : জাঁহাপনা, আপনার করুণার ঋণ আমরা কোনদিন শোধ দিতে পারব না।
হারুন : যাও, কোতোয়াল–এখন-ই হাব্সী তাতারীকে আমার বাগিচায় নিয়ে যাও। লেবাস সেখানে প্রচুর আছে। এই বেশে যেন কোনদিন ওকে আমি না দেখি।
[সকলে : সোবহান আল্লা, সোবহান আল্লা।]
হারুন : একটু সবুর করো, কোতোয়াল। তোমাদের হাসির জন্য আমি এই ইনাম দিলাম। দাঁড়াও দুইজনে। আর একবার সেই হাসি হাসো।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তার বোঝায় বান্দার ঘাড় ক্লান্ত। আজ হাসি আসতে পারে না, জাঁহাপনা।
হারুন : বেশ। কিন্তু মনে রেখো, হাসি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই হাসিই আমি শুনতে চাই। হ্যাঁ, আমি শুনতে চাই। আমার বুক যখন ভারাক্রান্ত থাকবে, তখনই তোমার হাসি আমি কামনা করব। যাও, এখন নাই-বা হাসলে। কোতোয়াল, একে নিয়ে যা। বাঁদী, তুমি মহলে ফিরে যাও।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, গোলাম ত চলে গেল। এখন আবু ইসহাকের কথা শুনুন। এই আরমেনী বাঁদী, তৌবা–এই আরমেনী আওরতের জন্য কি ইনাম দিবেন? কান শোনার জন্য পাগল।
হারুন : সে আরো বড় ইনাম। চলো মেহেরজান। আমাদের সঙ্গে চলো। তুমি বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যাও। তবে তুমি আর বাঁদী নও।
মেহেরজান : জাঁহাপনা, আপনি অশেষ মেহেরবান। আপনার মরজীই আমার মরজী।
হারুন : মেহেরজান, তুমিও এত মিষ্টি কথা বলতে পারো। আজব দুনিয়া। রাত্রি প্রায় শেষ। চলো মশ্রুর। আবু ইস্হাক, তোমার গজল-শোনা রাত্রি আবার আসবে। নিরাশ হয়ো না, কবি।
ইস্হাক : আলম্পানা, আবু ইস্হাক আশা মানে না–নিরাশা জানে না। আবু ইস্হাক বিশ্বের মুসাফির। সে যা দেখে, তারই গান করে। চলুন, জাঁহাপনা।…
০৮. অন্দর মহল
অন্দর মহল। আবু ইস্হাক ও হারুনর রশীদ।
–আবু ইস্হাক।
–জাঁহাপনা।
হারুন : হাব্সী গোলামের খবর জানো?
ইস্হাক : না, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : আমিও তিন দিন খোঁজ নিতে পারি নি, তাই বাগিচার মোহাফেজকে ডাকতে পাঠিয়েছি।
ইস্হাক : মোহাফেজ ডাকার দরকার নেই, আলম্পানা। গোলাম যা পেয়েছে, তার তুলনা নেই। এই বদান্যতা শুধু জিলুল্লাহ খলিফা হারুনর রশীদ-বিন্-মেহ্দীর পক্ষেই সম্ভব।
হারুন : তবু খোঁজ নিতে হয়। কারণ ওর হাসি শোনার প্রয়োজন আমার আছে। ঐ ত মশ্রুর মোহফেজ-কে নিয়ে হাজির। আহ্ আর কুর্ণিশের প্রয়োজন নেই। এসো, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মোহাফেজ হাজির।