মেহেরজান : দুয়ারে কে ঘা দিচ্ছে।
তাতারী : আমার ঘোড়াটা হয়ত দড়ি ছিঁড়ে আমার খোঁজে এসেছে।
মেহেরজান : না, না–এ তোমার পেয়ারা ঘোড়া নয়। মানুষ।
তাতারী : শুয়ে থাকো, কোন সাড়া দিও না।
মেহেরজান : আরো জোরে ঘা দিচ্ছে, দরজা ভেঙে পড়বে। আমি হলফ করে বলতে পারি ঘোড়া নয়। তুমি সাড়া দাও।
তাতারী : কে?
নেপথ্যে : দরজা খোল।
তাতারী : কেন?
নেপথ্যে : দরকার আছে।
তাতারী : কে?
নেপথ্যে : এই গোলাম, দরজা খোল। নচেৎ লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলব।
তাতারী : কে আপনি, জনাব?
নেপথ্যে : আমি মশ্রুর।
তাতারী : জাঁহাপনা, এখনই খুলছি। (ফিসফিস্ কণ্ঠে) মেহেরজান, সর্বনাশ! তুমি তাড়াতাড়ি বোরখা পরে নাও।
মেহেরজান : (ফিসফিস্ শব্দে) তাতারী, আল্লা যেন সহায়, নেঘাবান হন। কোথাও লুকানোর জায়গা নেই?
তাতারী : এই ছোট খুপরী, লুকাবে কোথায়?
মেহেরজান : তবে আল্লা যা নসীবে রেখেছেন, আমি বোরখা পরে নিই, তুমি দরজা খুলে দাও।
নেপথ্যে : এই জলদি কর, দরজা খোল্।
তাতারী : দিচ্ছি জনাব। বোরখা পরেছ?
মেহেরজান : পরেছি।
তাতারী : আসুন, জনাব। (নতজানু) আহ্লান ওয়া সাহলা ইয়া মওলানা। এ কি! স্বয়ং আমিরুল মুমেনীন। লা-হাওলা ওলা কুয়াতা, আলম্পানা, বান্দার গোস্তাখি মাফ করবেন। এই শির কালাম। গোস্তাখির জন্য আমার কঠোর সাজা দিন, জাঁহাপনা।
হারুন : তুই ঘরের প্রদীপ জ্বালিয়েছিস, আরো আলো–আরো রোশনাই চাই।
তাতারী : জাঁহাপনা গরীবের আর তো কিছু নেই। তবে পাশের প্রতিবেশীর কাছ থেকে চেয়ে আনি।
হারুন : মশ্রুর, কোতোয়ালদের একটা আলো আনতে বলো, শিগগির।
মশ্রুর : যে হুকুম, জাঁহাপনা।
তাতারী : আলম্পানা, গোস্তাখি মাফ করবেন বান্দার সওয়ালে। এই সুসাম রাত্রে আপনার পয়জার এই গোলামদের বস্তীতে জিল্লুল্লাহর আবির্ভাব? কিছু বুঝতে পারছি নে।
হারুন : আবু ইস্হাক।
ইস্হাক : জাঁহাপনা।
হারুন : আমার বদলে তুমি জবাব দাও।
ইস্হাক : এই গোলাম, জাঁহাপনা তোর হাসি শুনে খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই তোর জন্যে ইনাম নিয়ে এসেছেন।
তাতারী : ইনাম?
ইস্হাক : হ্যাঁ, ইনাম।
তাতারী : কিন্তু জাঁহাপনা, বান্দার কোন গুণ নেই, আর বান্দা এমন কোন কাজ করে নি, যার জন্যে সে ইনাম প্রত্যাশী হতে পারে।
ইস্হাক : গোলাম, তোর হাসি বড় মধুর। তাই আমিরুল মুমেনীন সেই হাসির রেশ ধরে এখানে এসে পৌঁছেছেন।
তাতারী : জনাব, বান্দাকে আর গোনাগার করবেন না। গোলাম, তার আবার হাসি!
হারুন : না, সত্যি। ইস্হাক আমার কথাই বলছে। আমি সেই জন্যেই এসেছি।
তাতারী : আমিরুল মুমেনীন, আল্লা আপনার শান শওকত আরো বৃদ্ধি করুন, আপনার দবদবা দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ুক। আপনি দুনিয়ার আমীর হন। গরীবের এই জুপড়িতে কি করে যে আপনারে জায়গা দিই।
মশ্রুর : চুপ কর, গোলাম।
হারুন : এই যে কোতোয়ালের আলো এনেছে। এখন চারিদিক বেশ চোখে পড়ে। এই গোলাম, ওটা কী?
তাতারী : কি জাঁহাপনা?
হারুন : ওই যে দেওয়ালের সাথে কালো বোরখা লেগে রয়েছে।
তাতারী : জাঁহাপনা–
হারুন : কি?
তাতারী : জাঁহাপনা–
মশ্রুর : জবাব দে, নফর।
তাতারী : জাঁহাপনা, বান্দাকে কতl করুন। বান্দা এই জবাব দিতে অক্ষম।
হারুন : জবাব দে, নচেৎ–
তাতারী : জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, এই বান্দরের জিভ ছিঁড়ে নাও, এখনও জবাব দিচ্ছে না।
মশ্রুর : আবু ইস্হাক, দ্যাখো দ্যাখো, গোলামটা ধুলোয় লুটিয়ে কাঁদছে, তবু জবাব দিচ্ছে না।
ইস্হাক : আমি দেখি, মশ্রুর। এই, আমিরুল মুমেনীনের সওয়ালের জবাব দে।
হারুন : মশ্রুর, যা ভেবেছিলাম তা নয়, না-ফরমান গোলাম। একে কতল করো এক্ষনি।
মেহেরজান : (বোরখা খুলিতে খুলিতে) না, না আমিরুল মুমেনীন। দেওয়ালের গায়ে শুধু বোরখা নেই, আমি আছি তার ভেতরে। ওকে মাফ করুন।
হারুন : আবু ইস্হাক, মশ্রুর দ্যাখো। বোরখার অন্ধকার ছিঁড়ে এই মাহতাব (চাঁদ) কোথা থেকে উদয় হোলো? থামো মশ্রুর। জবাব পাওয়া গেছে। এই, তুই কে?
মেহেরজান : (নতজানু) জাঁহাপনা, মজ্কুর জানানা আপনার বাঁদী।
হারুন : বাঁদী।
মেহেরজান : হা, জাঁহাপনা।
হারুন : কোন্ দেশী বাঁদী এমন?
মেহেরজান : আরমেনী বাঁদী, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : এই গোলাম, উঠে দাঁড়া। একটা জবাব দিবি, তবু এত ভয়। এ তোর কে?
তাতারী : আমার বিবি আলম্পানা।
হারুন : তোর বিবি?
তাতারী : হ্যাঁ, জাঁহাপনা।
হারুন: তুই শাদী করেছিস্, অথচ খবর দিস্ নি? গোলামের আস্পর্ধা বড় বেড়ে গেছে। আলেপ্পো শহরে কতকগুলো গোলামের তাই মাথা থেঁৎলে দিতে হোলো।
তাতারী : জাঁহাপনা, গোস্তাখি মাফ করবেন। আপনার পায়ের খাক্ এই গোলাম। তার আবার শাদী। তার আবার দাওয়াৎ।
হারুন : তোর কি জানা নেই, আপন মাওলার (প্রভু) হুকুম ছাড়া কোন গোলাম শাদী করতে পারে না বা নিজের বেটির শাদী দিতে পারে না?
তাতারী : জানি, জাঁহাপনা।
হারুন : তবে—
তাতারী : তার সাজা নিতে আমি প্রস্তুত আছি। অবাধ্য, নাফরমান বান্দার যা’ শাস্তি হয়, তাই আমার প্রাপ্য।
হারুন : হ্যাঁ, তোর গর্দান যাওয়াই উচিৎ। এই বাঁদী, তুই কোথা থাকিস্?
মেহেরজান : আপনার মহলের বাঁদী, জাঁহাপনা।
হারুন : আমার মহলের বাঁদী শাদী করেছে গোলাম, অথচ আমাকে কেউ জানায় নি। তাজ্জব ব্যাপার। তোকে কোনদিন দেখি নি?