না, না, দোষ কেন থাকবে? শ্যামাঙ্গ জানায়, আমার এখন মনে হচ্ছে, নবগ্রাম যাত্রা করাই বোধ হয় উত্তম ছিলো।
কেন? হঠাৎ একথা মনে হচ্ছে কেন? মেয়ে দুটি হতচকিত বোধ করে।
মনে হচ্ছে এজন্য যে শুনেছি, কামরূপ প্রভৃতি পূর্বদেশে রমণীরাই সমাজে সর্বেসর্বা। সেখানে পুরুষেরা কেউ বলীবর্দ, কেউ ছাগ, কেউবা কুক্কুর–এখন চিন্তা হচ্ছে, পুনর্ভবা তীরেও সেই রীতির প্রচলন হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি এই দীন অভাজন পুনরায় গৃহের মুখ দেখতে পাবে?
শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুই তরুণীই হেসে উঠলো।
ললিত প্রেক্ষণা রমণীর আননে সকৌতুক হাস্য পরিহাস যে বিচিত্র ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে তা শ্যামাঙ্গের অজানা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্মুখের তরুণী দুটির হাস্যাননে কোনো প্রকার ইন্দ্রজালই সে সৃষ্টি হতে দেখলো না। যা দেখলো তা নিতান্তই সহজ কৌতুক–এবং তাতে তার মন হয়ে উঠলো ভারমুক্ত। কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা বা মানসিক পীড়ন ঐ সময় তার অনুভূতিতে আর রইলো না।
শ্যামাঙ্গ নগরবাসী রাজপাদোপজীবী অথবা সামন্তপ্রভু গৃহের যুবকপুত্রদের মতো লীলারঙে কুশলী নয়। হলে সে এই কৌতুকহাস্যকে দীর্ঘায়ত করতে সচেষ্ট হতো। এবং হাস্যালাপের সূত্র ধরে প্রণয়াসক্তি প্রকাশের চেষ্টা করতো। তাই কৌতুকের ভাবটি সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। কারণ ওদিকে দিবা অবসান প্রায়–এবং তরুণী দুটি ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তদুপরি তার নিজেরও একটি রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সে কখনও বামে কখনও দক্ষিণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। যদি কোনো বয়স্ক পুরুষ গোচরে আসে।
শ্যামাঙ্গনা তরুণীটি তা লক্ষ্য করে থাকবে। বললো, পথিক কি কাউকে সন্ধান করছেন?
হ্যাঁ, আপনাদের গ্রামে দেখছি পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প।
কেন, তাতে কি ভয় হচ্ছে? মেয়েটির স্বরে কৌতুক ঘোচে না। কপট আশ্বাস দেয় সে। বলে, আপনার ভয়ের কারণ নেই, বলীবর্দ, ছাগ অথবা কুক্কুর কোনোটারই আমাদের প্রয়োজন নেই।
আহা যদি হতো! শ্যামাঙ্গ যেন দীর্ঘশ্বাস মোচন করে।
হলে কি ভাল হতো? মেয়েটির চোখে ঈষৎ বিস্ময় ফোটে, এই না বললেন যে আপনার ভয় হচ্ছে–আবার এখনই হায়–হুতাশ কেন?
শ্যামাঙ্গ আক্ষেপ করে বলে, হায় যদি আপনাদের প্রয়োজন হতো, তাহলে বলীবর্দরূপে হোক, কি ছাগরূপে,–রাত্রিযাপনের একটা ভালো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আমার জন্য করতেন আপনারা।
তরুণী দুটি আবার বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করে। তাদের মুখ দেখে শ্যামাঙ্গ বোঝে, পথিককে তারা যে গৃহে আমন্ত্রণ জানাতে পারছে না, এই জন্যই তাদের মুখে ঐ বিব্ৰত ভাব। সে তখন জানতে চাইলো, আচ্ছা, আমি যদি ঐ মন্দিরে গিয়ে রাত্রিযাপনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাহলে কেমন হয়?
না, স্বল্প–শ্যামা উত্তরে জানায়, আপনি বরং আমাদের গ্রামে যান–আমার পিতা শুকদেব, মাতুল দীনদাস। গ্রামে গিয়ে এঁদের সন্ধান করবেন এবং নিজ পরিচয় দিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।
ক্ষণেক চিন্তা করে হঠাৎ মেয়েটি জানতে চাইলো, আম্রপট্টলী গ্রাম কি চেনেন আপনি? আত্রেয়ী তীরের আম্রপট্টলী?
কেন, ঐ গ্রামে কে আছে আপনার? শ্যামাঙ্গ কৌতূহলী হয়। আম্রপট্টলী গ্রাম সে বিলক্ষণ চেনে–সেখানে তার মাতুলালয়। বললো, আমার গ্রাম রজতপট, আম্রপট্টলী থেকে দূরত্ব পাঁচ ক্রোশের মতো।
শ্যামাঙ্গের কথায় যেন উৎসাহ বোধ করে মেয়েটি। বললো, আম্রপট্টলীতে আমার ননদের শ্বশুরালয়। আমার পিতাকে বলবেন যে অনন্তদাসকে আপনি চেনেন। আমার ননদের নাম ব্রজতারা, মোহনদাস তার স্বামী, অনন্তদাসের পুত্র। আমার নাম মায়া, মায়াবতী–বলবেন যে আমার নাম আপনি জানেন।
ব্যাপারটি বেশ জটিল। মায়াবতীর ননদ ব্রজতারা, তার স্বামী মোহনদাস, মোহনদাসের পিতার নাম আবার অনন্তদাস–নিবাস আম্রপট্টলী গ্রাম–অতি দীর্ঘ একটি তালিকা। শুধু এইটুকুই নয়–একটি সম্পূর্ণ কাহিনী নির্মাণ করতে হবে তাকে এখন এবং সর্বক্ষণ সেটি মনে রাখতে হবে। তারপরও রয়েছে মায়াবতীর স্বামীর নাম, শ্বশুরের নাম, তাদের গ্রামের নাম–সম্পূর্ণ ব্যাপারটি আয়ত্তে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। মায়াবতীর পরামর্শ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না তার কাছে। বললো, আতিথ্য লাভের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? এই কি নিয়ম নাকি এদেশে?
ঐ প্রশ্নে মায়াবতী গম্ভীর হয়ে উঠলো। বোধ হয় কিঞ্চিৎ আহত হলো সে। তার সঙ্গিনীও যে খুব প্রসন্ন হয়েছে এমন মনে হলো না। মায়াবতী সঙ্গিনীকে ডেকে বললো, আয় লীলা, আমরা যাই, বেলা গেলো।
তাহলে এ হলো মায়া, শুকদেবের কন্যা, আর ঐটি হলো লীলা, সম্ভবত লীলাময়ী অথবা লীলাবতী। শ্যামাঙ্গের নাম দুটি মধুর বোধ হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, মায়াবতীদের গৃহেই সে আতিথ্য প্রার্থনা করবে।
অদূরে মেয়ে দুটি উচ্চ আলপথের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লীলাবতীর কেশভার বিপুল। নদীতীরের বাতাসে তার শিথিল কবরী বিস্রস্ত হওয়ায় বারবার তাকে দুহাত তুলে কবরী বন্ধন করতে হচ্ছিলো। আর ঐ সময়ই শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে লীলাবতীর দেহসৌষ্ঠব অনিন্দ্য। সে একটি অপরূপ যক্ষিণী মূর্তি দেখেছিলো সোমপুর মহাবিহারে। লীলাকে দেখে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত পীবরস্তনী, বিপুলজঘনা, সুকেশী যক্ষিণী মূর্তিটি বারবার তার মানস চক্ষে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এবং নিজ বক্ষের অনেক গোপনে কোথায় যেন সে বারবার শিহরিত হতে লাগলো।