নবগ্রাম হাটের নাম শুনে শ্যামাঙ্গ আগ্রহী হয়। সুহৃদ নীলাম্বর নবগ্রাম হাটের কথা বারংবার বলে দিয়েছে। সে জানতে চাইলো, নবগ্রাম কি এ স্থান থেকে অধিক দূর?
না না, দূর কেন হবে? জলসিক্ত প্রৌঢ় লোকটি জানালো। বললো, এই ক্রোশ তিনেক পথ হবে।
ক্রোশ তিনেক। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণে। তার অনুমান ছিলো, নবগ্রামে যদিবা সে নাও এসে থাকে তাহলে অন্তত পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামে এসেছে–উজুবট নবগ্রাম হাটেরই নিকটবর্তী কোনো স্থান হবে। কিন্তু এখন? সে পশ্চিমাকাশে চাইলো–সূর্যাস্তের আর দণ্ডাধিককাল দেরী–যদি যেতে হয়, তাহলে এখনই তার যাত্রারম্ভ করা উচিত। পথিমধ্যে হয়তো রাত্রি হবে–কিন্তু উপায় তো কিছু নেই, তিন ক্রোশ পথ সহজ ব্যাপার নয়।
সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। পাদুকা যুগল পরিধান করে, উত্তরীয় খানি স্কন্ধে রাখে এবং তার যথাসর্বস্ব পুটুলিটি হাতে তোলে।
তাকে ঐভাবে উদ্যোগী হতে দেখে প্রৌঢ়টি বললো, মহাশয় তিন ক্রোশ পথ কম নয়, আপনি অচেনা মানুষ, এই সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা না করলেই ভালো।
শ্যামাঙ্গ সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেয়—হ্যাঁ, সন্ধ্যার আর সত্যিই দেরি নেই। কৌতূহলী গ্রামবাসীরা কৌতূহল নিবৃত্ত করে চলে যাচ্ছে। প্রৌঢ় লোকটিও চলে গেলো। আশ্চর্য ব্যাপার! তাকে সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা করতে নিষেধ করলো প্রৌঢ় লোকটি, অথচ তার রাত্রিযাপনের কি ব্যবস্থা হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বললো না। তার অনুমান হয়, বোধ হয় তাকে আবার বিপদে পড়তে হবে।
ঐ সময় তার প্রৌঢ় পথিকের কথা মনে পড়ে। মনে মনে তুলনা করে, দণ্ড কয় আগে তার ভালো–মন্দ নিয়ে এক প্রৌঢ়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না–আর এখন অন্য এক প্রৌঢ় তার সমস্যার কথা জেনেও কিছু করার চেষ্টা করলো না। সে উঠে দাঁড়ায়, আপাতত যাত্রারম্ভ করাই বিধেয়। পথিমধ্যে যদি তেমন বোঝে, তাহলে পথিপার্শ্বেরই কোনো গ্রামে হয় আশ্রয় প্রার্থনা করবে।
কিন্তু প্রথম পদক্ষেপণের মুহূর্তেই তাকে থামতে হলো। শুনলো, পথিক মনে হচ্ছে যাত্রারম্ভ করলেন?
তরুণী দুটি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেনি। সে ঘুরে দাঁড়ালো। এবং মৃদু হাস্যে বললো, হ্যাঁ ভাবছি, নবগ্রাম পর্যন্ত চলে যাই।
তার কথায় দুজনের মুখেই ঈষৎ উদ্বেগের ছায়া দেখা গেলো। একজন বললো, নবগ্রাম তো অতি নিকটে, তাই না?
হ্যাঁ, এক প্রৌঢ় তো তাই বললেন, মাত্রই তিন ক্রোশ।
হ্যাঁ, মাত্র তিন ক্রোশ, উজ্জ্বলতরা তরুণীটির চোখে মুখে কপট কৌতুক দেখা গেলো ঐ সময়। বললো, এই তিন ক্রোশ পথ সূর্যাস্তের মধ্যে অতিক্রম করতে আপনার অসুবিধা হবে না তাই না?
না, তা নয়, শ্যামাঙ্গ স্বীকার করে, পথিমধ্যে রাত্রি অবশ্যই হবে।
তাহলে? দুজনের কণ্ঠ থেকে একসঙ্গে শব্দটি উচ্চারিত হয়।
তাহলে কী, শ্যামাঙ্গ জানতে চায়, পথ দুর্গম? পথিমধ্যে অরণ্য আছে? ব্যাঘ ভল্লুক আক্রমণ করে?
স্বল্প শ্যামা তরুণীটি জানায়, শুনুন মহাশয়, ও কাজও করবেন না। পথিমধ্যে অরণ্য আছে তা ঠিক এবং অরণ্যের ব্যাঘ্র ভল্লুকের আক্রমণের ভয়ও আছে। তবে সর্বাপেক্ষা ভয়ের কারণ অরণ্য সংলগ্ন গ্রামগুলি–ঐ গ্রামগুলিতে দস্যু তস্করের বাস। যাত্রা করতে চাইলে ভেবে–চিন্তে তবে যাত্রা করুন।
শ্যামাঙ্গকে এবার ভাবতে হয়। তার কটিদেশে গ্রন্থিবদ্ধ স্থলীতে যা আছে তার মূল্য খুব বেশি না হলেও একেবারে তুচ্ছ নয়। উপরন্তু প্রৌঢ় পথিক আবার কিছু মুদ্রা তাকে দান করেছেন। এ তো মহাবিপদ। সে মনে মনে কিছুটা আতঙ্ক বোধই করে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে হাসে, বলে, কিন্তু আমার যাত্রা করা ছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন? এখানে আমাকে কে থাকতে দেবে?
ঐ কথায় দুই তরুণীই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। বোঝা যায় তারা দারুণ বিব্রত বোধ করছে। উত্তরে তারা কিছুই বলে না এবং এমন ভাব করে, যেন তাদের ব্যস্ততা আছে এবং অচিরাৎ তাদের গৃহে ফেরা প্রয়োজন।
আচ্ছা, এখানে কোনো মন্দির নেই? শ্যামাঙ্গ জানতে চায়।
হ্যাঁ আছে, কেন থাকবে না, একজন হাত তুলে দেখায়, ঐ যে দেখুন, মন্দিরের ধ্বজা উড়ছে।
শ্যামাঙ্গ সেদিকে লক্ষ্য করেনি তা নয়। সে পূর্বেই দেখেছে চক্রলাঞ্ছিত গৈরিক ধ্বজা চৈত্রের বাতাসে সতেজে উড্ডীন। সে বলে, কিন্তু ও তো বিষ্ণুমন্দির, সম্ভবত ব্রাহ্মণদের নিবাস ওখানে, নিকটে কোনো শিবমন্দির নেই?
পথিক কি শিবভক্ত? আবার কৌতুক ফোটে শ্যামাঙ্গী তরুণীটির স্বরে।
না, শ্যামাঙ্গ জানায়।
তাহলে কী?
এবার উজ্জ্বলবর্ণা মেয়েটির চোখে হাসি দেখা গেলো। বললো, ব্রাহ্মণ নয়, শিবভক্ত নয়, তাহলে কী?
কেন ব্রাহ্মণ ও শিবভক্ত ব্যতীত কি অন্য কিছু হওয়া যায় না?
যাবে না কেন? শ্যামাঙ্গী মেয়েটি উত্তর দিলো। বললো, শিবভক্ত না হয়ে যখন কোনো অপরিচিত আগন্তুক শিব মন্দিরের আশ্রয় সন্ধান করে, তখন তার পরিচয় জানতে চাওয়া গ্রামবাসীর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।
শ্যামাঙ্গ ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে, এই তরুণীটির বুদ্ধি যেমন প্রখর বাকপটুতাও তেমনই অসাধারণ। তার বাক্যালাপ সে উপভোগ করতে লাগলো। বললো, জানা ছিলো না যে, পুরুষ নয়, নারীরাই পুনর্ভবা তীরে কোট্টপালের দায়িত্ব পালন করে।
তরুণীটি অপ্রতিভ হয় না। বলে, যদি তাই–ই হয়, তাহলে কি দোষ আছে কিছু?