দৃশ্যটি শ্যামাঙ্গ উপভোগ করলো, এবং অপেক্ষা করতে লাগলো, দেখা যাক, ঐ জালধারীর ভাগ্য পরবর্তী প্রচেষ্টায় কী এনে দেয়।
আর ঠিক ঐ সময় তার কানে এলো হাস্যমুখরা দুই রমণী কণ্ঠের আলাপ। একজন বলছে, চুপ চুপ দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা ভয় বলতে কি কিছুই নেই একেবারে?
কেন লো? আমি কি তোর মতো ভর্তাতাড়িতা যে আমার লজ্জা থাকবে?
বৃক্ষতলের বেদী যথেষ্ট উঁচু, সম্মুখের ভূমি নিম্নগামী এবং ঐ নিম্নভূমি থেকেই উঠে আসছিলো দুই সখী এবং তাদের আলাপ।
শ্যামাঙ্গ উঠে বসতেই মুখোমুখি হলো। দেখলো, দুটি শ্যামবর্ণা যুবতী পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। সম্মুখে হঠাৎ অপরিচিত যুবাপুরুষ দেখে ঈষৎ বা অপ্রতিভ।
লক্ষ্য করে শ্যামাঙ্গ, দুজনেই ঈষৎমেদা এবং শ্রোণীভারানতা। তবে আবার দুজনকেই ঈষৎ চঞ্চলও মনে হয়। হয়তো নবীন যৌবনের কারণে দুজনেরই কৃষ্ণ অক্ষিপক্ষ্মে কৌতুক ও কৌতূহল। শ্যামাঙ্গ মৃদু হাস্যে বললো, আমি ভিন্নদেশী পথিক, এই গ্রামের নাম কি, বলবেন?
তরুণী দুটি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে। তারপর ধীরপদে কাছে আসে। জানায়, গ্রামের নাম উজুবট, গ্রামপতি বিপ্রদাস–এবং ঐ যে দেখা যায়–হাত তুলে দেখায় একজন, ঐখানে আমাদের গ্রাম। শ্যামাঙ্গ দেখে, দূরে আম্রবীথি এবং তার ওপারে একটি মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে। তরুণীটি জানায়, ঐ মন্দিরের কাছে গ্রামপতির গৃহ।
তরুণী দুটি তৎক্ষণাৎ চলে গেলো না–একটি সহজ, কৌতূহলী এবং আগ্রহী ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্যামাঙ্গের মনে হলো, এ অঞ্চলের নারীরা সম্ভবত অধিকতর শিথিলশাসনা। সে কারণেই অহেতুক লজ্জা বা সঙ্কোচ দেখছে না তরুণী দুটির আচরণে। বরং সহজেই তারা কৌতূহল প্রকাশ করছে। দুজনেই নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। যেমন, পথিক কি পূর্বে এদিকে আসেননি? আপনার নিবাস কোথায়? রজতপট গ্রাম শুনেছি অনেক দূর–আপনি কি পদব্রজে যাবেন? আচ্ছা, আত্রেয়ী নদী কি আরও প্রশস্তা?
প্রশ্নগুলির প্রত্যেকটিরই উত্তর দিতে হলো শ্যামাঙ্গকে। ইতোমধ্যে একটি বৃদ্ধা এসে উপস্থিত হয়েছে। সেও আলাপে যোগ দিলো। বৃদ্ধার রসনা প্রখর, তদুপরি সে সুরসিকা। ফলে তরুণী দুটির স্বভাবত সংকোচও আর থাকলো না। যখন বৃদ্ধা জানতে চাইলো, পথিক এই নবীন যৌবনে বিবাগী কেন–এই বয়স তো প্রব্রজ্যার নয়? তখন সকৌতুকে শ্যামাঙ্গের মুখপানে দৃষ্টি রাখলো তরুণী দুটি।
আর সে জন্যই বৃদ্ধার কথার উত্তর দেবার পূর্বে দুমুহূর্ত ভাবতে হলো শ্যামাঙ্গকে। সে বুঝলো, বৃদ্ধা তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে রসিকতা করতে চাইছে। বললো, আয়ি, আপনার মতো কেউ যদি থাকতো, তাহলে কি এই অধম দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ায়?
বৃদ্ধা হাসিতে ভেঙে পড়ে। মেয়ে দুটিকে বলে, দেখ লো, পথিক কি চতুর–আমাকে সম্বোধন করলেও বক্তব্য কিন্তু তোদেরই শোনাচ্ছে। তোরা সাবধান হ।
বৃদ্ধার ঐ সরস কটাক্ষের উত্তরে, যে অধিকতর শ্যামা, সে বললো, আয়ি, আমাদের তো লোক আছে, তোমারই নেই–তুমি বরং ভেবে দেখতে পারো।
ঐ সময় নদীকূল থেকে একটি বালকের চিৎকার শোনা গেলো, তার মাছ কে একজন ছিনিয়ে নিচ্ছে। ঐ গোহারি শুনে বৃদ্ধা দাঁড়ালো না। যাবার সময় বলে গেলো, ওলো তোরা পথিককে ছাড়িস নে–আমি আসছি।
আয়ি সুরসিকা, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে।
আমরাও দেখি, কি কি মাছ ধরা পড়লো।
শ্যামাঙ্গের মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে তরুণী দুটি নদীতীর অভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গ পেছন থেকে ডেকে বললো, বৃহৎ রোহিত ধরা পড়লে নিমন্ত্রণ যেন পাই, দেখবেন।
শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুজনই ঘুরে দাঁড়ায়। দুজনেরই অক্ষিতারকা নৃত্যপর হয়, পথিক কি ব্রাহ্মণ?
কে ব্রাহ্মণ? আমি? শ্যামাঙ্গ অবাক হয়।
নাহলে রোহিত ভোজনের জন্য এরূপ উদগ্র বাসনা কেন?
শ্যামাঙ্গ প্রায় মুগ্ধ হয়ে গেলো। শ্যামা তরুণীটি বড়ই বুদ্ধিমতী। সে সহজ স্বরে বললো, পথিকের আর দোষ কি বলুন, পুনর্ভবা তীরের রন্ধন নৈপুণ্যের খ্যাতি কে না জানে, তদুপরি নবাম্র আর সজিনাদণ্ডিকার ঋতু এখন–এ সময় ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নির্বিশেষে সকল রসনারই উদগ্র হওয়ার কথা, আশা করি আপনাদের অজানা নয় সে কথা।
তা নয়, উজ্জ্বলতরা তরুণীটি জানায়, কিন্তু এও মনে রাখবেন, এতদঞ্চলে ঝালের ব্যবহার বেশি। ঝালতপ্ত ব্যঞ্জন ভোজনের অভ্যাস কি আছে পথিকের?
শ্যামাঙ্গ হাসে। মনে মনে বলে, ঝালের কেমন ব্যবহার তা বাপু বিলক্ষণ অনুভব করছি। প্রকাশ্যে বলে, এ অধম ব্রাহ্মণও নয়, শিশুও নয়, যে ননীছানাভুক হবো, আপনারা নিমন্ত্রণ করে দেখুন একবার।
আচ্ছা সে দেখা যাবে, বলে মেয়ে দুটি অতঃপর বিদায় নেয়।
শ্যামাঙ্গ এবার বেদী থেকে নেমে দাঁড়ায়। দেহের ক্লান্তি এবং অবসাদ সত্যিই এবার অনেকখানি দূর হয়েছে। সে দেখে, মৃত নদীর কর্দমাক্ত জলাশয় থেকে সিক্ত বস্ত্রে একে একে মৎস্য শিকারীরা উঠে আসছে। প্রত্যেকের কটিবন্ধনীতে মৎস্যমালা বিলগ্ন। বৃহদাকৃতির মৎস্য প্রায় কারও ভাগ্যেই জোটেনি।
তারা একে একে কৌতূহলভরে বৃক্ষতলে এসে দাঁড়ায়। কারও হাতে ক্ষুদ্রাকৃতি জালিকা। কারও হাতে লৌহাগ্র কোঞ্চ, কারও হাতে বংশখণ্ডিকা নির্মিত পলই। সকলেই শ্যামাঙ্গ সম্পর্কে জানতে চায়। ক্রমে তারা একযোগে ঘিরে দাঁড়ালো। আর তাতে অদ্ভুত একটি অনুভূতি হলো শ্যামাঙ্গের। জলের, মৃত্তিকার, আমিষের সম্মিলিত একটি গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। একবার ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, সে যেন অন্য মানুষ। সমাগত লোকেরা নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। কেউ কেউ নাম পরিচয় জানতে চায়। সে আত্রেয়ী তীরের মানুষ জানতে পেরে কয়েকজনের আগ্রহ কিঞ্চিৎ অধিক হলো। অত দূরের মানুষ এ অঞ্চলে অহরহ আসে না। যাদের আত্মীয়স্বজন ঐ দূরদেশে থাকে, তারা নানাবিধ কুশলাদি জানার প্রত্যাশী। যেমন, মহাশয় কি নীলাঞ্জন গ্রামের দিবোনাথকে চেনেন? আপনার গ্রাম থেকে মালঞ্চি গ্রাম কত দূর? আত্রেয়ী তীরের কুম্ভকারেরা কি আর মৃৎপাত্র নির্মাণ করে না? এই প্রকার একের পর এক প্রশ্ন। শ্যামাঙ্গ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কোনোটির পারে না। ওরাই জানালো, আত্রেয়ী করতোয়া সংগম এখান থেকে বিশ ক্রোশাধিক পথ। এ গ্রামের হাটে কদাচিৎ আসে আত্রেয়ী তীরের মানুষ। আপনি বরং নবগ্রাম হাটে যান, একজন পরামর্শ দিলো, ওখানে প্রায় নিয়মিতই আত্রেয়ী তীরের বহু শকট আসে।