শ্যামাঙ্গ বিরক্তি বোধ করেছে নীলাম্বরের কথায়। বলেছে, মিত্র নীলাম্বর, তুমি আমার কথা বুঝবে না। যদি বুঝতে, তাহলে মৃত্তিকা নিয়েই কাজ করতে।
নীলাম্বর ঐ কথার পর শ্যামাঙ্গকে পরিত্যাগ করেছে। ঐ কটি দিন ছিলো অশেষ যন্ত্রণার। একটি কথাই বারবার তার মনে আলোড়িত হচ্ছিলো। গুরু বসুদেব কেমন করে বললেন যে তিনি আদেশের দাস? তুমি বলতে কি তিনি তার মতো সকল শিল্পীকে বুঝিয়েছেন? শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই? ধীমান বীটপাল কি রাজাদেশের দাস ছিলেন? প্রথা এবং অনুশাসন ছিন্ন করেন যে শিল্পী তিনি কি ক্রীতদাস হতে পারেন? বসুদেবই তো জানিয়েছেন যে, একদা বরেন্দ্রভূমির মৃৎশিল্পীরা মৃত্যলকে উত্তীর্ণ করেছেন জনজীবনের দৃশ্যমালা। যোগীভিক্ষু, মৃগয়া প্রত্যাগতা ব্যাধরমণী, শৃঙ্গার মগ্ন মানব–মানবী, ঢাল তরবারি হস্তে বীর ধটিকা পরিহিতা বীরাঙ্গনা–এসব দৃশ্যে উত্তীর্ণ মৃৎফলক সোমপুরী মহাবিহারের প্রাচীর গাত্রে এখনও শোভা পাচ্ছে। ঐসব কাজ যে গৌরবের বস্তু–একথাও গুরু বসুদেবই জানিয়েছেন। তাহলে তিনি এখন এমন কথা কেন বলছেন?
সে জানে, বসুদেব যৌবনকালে দরিদ্র জীবনযাপন করতেন। রাজানুগ্রহ লাভের চেষ্টা কখনই করেননি। কখনও তাঁর কেটেছে আত্রেয়ী তীরে, গ্রাম জনপদগুলিতে, কখনও গিয়েছেন রামাবতী পুন্ড্রনগরে, কখনও সোমপুরে। প্রতিমালক্ষণশাস্ত্র তাঁর নখদর্পণে। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের প্রতিমা নির্মাণকলা কেমন করে গৌড়ীয় রীতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে–সমস্ত কিছু জানেন তিনি। কী নিষ্ঠা তাঁর, কী সাধনা! চিন্তা করলে বিস্ময় লাগে। অথচ সেই বসুদেবই এখন কী হয়েছেন। তার আচরণ হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য। মহাসামন্ত সুধীমিত্রের আদেশ কি এতোই দুর্লঙ্ঘ্য? তার মনে প্রশ্ন জাগে।
মনে অপরিসীম বেদনার ভার। কাজে মন বসে না। এমনকি সমাপ্তপ্রায় কাজগুলি সম্পন্ন করতেও সে উৎসাহ পাচ্ছিলো না। রৌদ্রশুষ্ক ফলকসমূহ যে অগ্নিদগ্ধ করবে, সে উদ্যমটুকুও তার ঐ সময় ছিলো না।
ঐ সময় একদিন বসুদেব স্বয়ং এলেন এবং কিছু ফলক বেছে বেছে একদিকে পৃথক করে রেখে অবশিষ্টগুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, শ্যামাঙ্গ, এসব অপ্রয়োজনীয় এসব ভেঙে ফেলে নতুন করে প্রস্তুত করো।
একেবারেই অবিশ্বাস্য! বসুদেবের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায় না। তবু শ্যামাঙ্গ জানিয়েছিলো, গুরুদেব, মার্জনা করবেন–এগুলি আমার বহুবর্ষের সাধনার ফল–এগুলি বিনষ্ট করা যাবে না।
বসুদেব কঠিন স্বরে জানতে চেয়েছিলেন, কেন, অদগ্ধ মৃৎফলক বিনষ্ট করা তো কষ্টসাধ্য কাজ নয়।
তা নয়, কিন্তু এ সমস্তই শিল্পকর্ম।
শিল্পকর্ম? বসুদেবের ক্রুদ্ধস্বর চিৎকার হয়ে উঠেছিলো। বলেছিলেন, শিল্পকর্ম কাকে বলে তুমি জানো? এসব যা রচনা করেছো–শুধুই জঞ্জাল, বুঝেছো? এসব জঞ্জাল বিনষ্ট করতে কোনো কষ্টই হয় না।
দেখো, এইভাবে নষ্ট করা যায়, ভালো করে দেখে রাখো। দেখতে দেখতে ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত বসুদেব পদাঘাতে মৃৎফলকগুলি ভাঙতে আরম্ভ করে দেন। রক্তিম চক্ষু, উন্মাদ পদতাড়না, তীব্র চিৎকার–সব মিলিয়ে তখন তাকে অন্য এবং অচেনা মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়ে দেখছিলো, কিছু বলতে পারেনি।
শ্যামাঙ্গ পারেনি, কিন্তু বসুদেব পেরেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাকে এখানে আর প্রয়োজন নেই–তুমি এবার যেতে পারো। আমি তোমার মঙ্গল চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার স্পর্ধা এবং দুর্বিনয় একেবারেই সীমাহীন–আর আমি তোমার মুখদর্শন করবো না।
এখানে তোমার স্থান হবে না শ্যামাঙ্গ, এক সময় শান্ত স্বরে জানিয়েছেন বসুদেব। বলেছেন, সুধীমিত্র তোমার সমস্ত মৃৎফলক অযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন–আমি অনুরোধ। করেছিলাম, কয়েকটি ফলক যেন গ্রহণ করেন, কিন্তু দেখলাম, কাজ হলো না–তুমি যাও।
শ্যামাঙ্গ কিছুই বলেনি অতঃপর। গুরু বসুদেবকে প্রণাম করে প্রায় রাত্রি শেষে বিল্বগ্রাম থেকে সে বিদায় নিয়েছে।
০২. মৎস্য শিকারের কোলাহল
মৎস্য শিকারের কোলাহল তখনও সমানে হয়ে চলেছে। সূর্য নেমেছে আরও নিচুতে। শ্যামাঙ্গ বারংবার তার মৃৎফলকগুলির কথা ভাবছিলো। জীবন্ত এবং উজ্জ্বল যে চিত্রমালা এখন চোখের সম্মুখে দেখছে–তাই তো সে ধরে রেখেছিলো তার মৃৎফলকগুলির মধ্যে। কিন্তু বসুদেব বুঝলেন না। এখন একটি দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার মনে হচ্ছে গুরু বসুদেবের ঐ আচরণ প্রকৃতই নাটকীয়। ঐ আচরণে কোনো মহত্ত্ব আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। চোখের সম্মুখে নতুন চিত্রমালার জীবন্ত বিষয়গুলি যতোই সে দেখছে, ততোই তার গুরুদেবের ওপর করুণা হচ্ছে। গুরু বসুদেব যদি প্রকৃতই শিল্পী হতেন, তাহলে তিনি সুধীমিত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করতেন এবং যা তিনি শিষ্যদের বলেছেন তা–ই নিজের জীবনে পালন করতেন। তিনি সে চেষ্টা আদৌ কখনও করেছেন কি না তাই এখন সন্দেহের বিষয়। তিনি কি শিষ্যের পক্ষ নিয়ে সুধীমিত্রের বিরোধিতা করেছেন? করেননি। তাহলে তাঁর ঐ ক্ষিপ্ত উন্মাদ আচরণের কোনো তাৎপর্যই থাকে না। তুমি অন্তরে সৎ থাকবে, মহান থাকবে, কিন্তু বাইরে কিছুই বলবে না, এভাবে কি শিল্পী জীবনযাপন করতে পারে?
হঠাৎ সমস্বরে চিৎকার উঠতেই শ্যামাঙ্গ দৃষ্টি প্রসারিত করলো। দেখলো, একখানি চতুষ্কোণ জালে একটি মধ্যমাকার রোহিত মৎস্য লম্ফঝম্প করছে এবং দুতিনটি কিশোর ছুটে যাচ্ছে ঐ জালের দিকে। কিন্তু লাভ হলো না। করায়ত্ত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রোহিতটি সজোর লম্ফ দিলো। এবং সবাইকে হতাশ করে নিমেষে পতিত হলো জলে।