বসুদেব দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বলেন, এ কী করেছো তুমি? এসব কেন করেছো? দেব মন্দিরের সঙ্গে এসবের প্রসঙ্গ কোথায়?
শ্যামাঙ্গ সবিনয়ে বোঝাতে চেয়েছে, প্রভু, শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন সেই প্রসঙ্গেই আমার শবর যুবতীর কথা মনে হয়েছে–আর ধীবর মাতা গোদাবরী তীরের। বনবাসের দৃশ্যে অরণ্যচারী ব্যাধ যুবক–যুবতীর প্রণয় কি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে?
না, বসুদেব কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেছেন, এ হয় না, প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারটি তুমি ছলনাক্রমে আনছো। এ কেমন মুখাবয়ব, এ কেমন মুখভাব বলো? এ মানবিক লালিত্যে কি প্রয়োজন? কেন তোমার ফলকচিত্রে কেবল নমনীয় পেলব রেখা? কেন এই বৃত্তাকার ভঙ্গি? ঋজুতা কোথায়, দৃঢ়তা কাঠিন্য কোথায়? ওষ্ঠ কেন এমন বিলোল হবে? এ হয়নি সব ভুল হয়েছে তোমার। শ্রীরামচন্দ্রের কি এই মুখাবয়ব হয় কখনও? জানকী আর যক্ষিণী মূর্তিতে যে কোনো পার্থক্য নেই। এসবে কাজ হবে না–বিনষ্ট করো এসব।
ঐ কঠিন রুক্ষ নির্দেশ যেন এখনও বক্ষের নিচে এসে আঘাত করে। শ্যামাঙ্গ স্মরণ করে শিহরিত হলো।
ঐ সময় কাতর আর্তনাদ করে উঠেছিলো শ্যামাঙ্গ। আকুল প্রার্থনার মতো করে বলেছিলো, গুরুদেব, এসব মূর্তিতে যে আমার আবেগ স্পন্দিত হয়েছে, রক্ত ধারার ছন্দ যে এদের রেখায় বিধৃত হয়ে রয়েছে। দেখুন আপনি, এই ব্যাধ তরুণ–তরুণীর মুখভাবে সঙ্গীত মর্মরিত হচ্ছে কি না?
বসুদেব প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন–কেন যে হঠাৎ অমন আচরণ করলেন, শ্যামাঙ্গ এখনও কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। বসুদেব বলে উঠেছিলেন, মূর্খ, তুমি শ্যামাঙ্গ, একেবারেই মহামূর্খ। তোমার স্মরণে থাকা উচিত যে এসব নির্মিত হচ্ছে তোমার পিতৃধনে নয়। এসব নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার বহন করছেন কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত সুধীমিত্র। সুতরাং তার আদেশ–নির্দেশই তোমাকে মান্য করতে হবে। তুমি আদেশের দাস মাত্র–তাঁর আদেশ পালনের জন্যই তোমাকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে–প্রতিমা নির্মাণশাস্ত্র ব্যাখ্যার জন্য নয়।
ঐ সময় সুধীমিত্রের আশ্রিত উদ্ধব দত্ত এসে দাঁড়িয়েছিলো কাছে, কাজ ছেড়ে উঠে এসেছিলো সতীর্থ নীলাম্বর। নীলাম্বরই তাকে সরিয়ে আনে বসুদেবের সম্মুখ থেকে।
সরিয়ে এনে বলে, কাজটা তুমি ভালো করোনি বন্ধু।
শ্যামাঙ্গ তখনও ক্ষুব্ধ। জানায়, কিন্তু আমার অপরাধ কোথায়? গুরুদেব সেটা তো আমাকে বলছেন না–কেবলই ধর্মের কথা আর শাস্ত্রের কথা বলছেন।
শ্যামাঙ্গ ঐ বিতর্কের কথা জীবনে ভুলবে না। তার সাধ এবং আশা সে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছে সুধীমিত্রের ঐ মন্দিরেই। না, আর সে শিল্প রচনায় যাবে না।
ঐ গুরুদেবই তাকে সংবাদ পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুধীমিত্রের বিল্বগ্রামে। বলেছিলেন, মৃত্যলকের কাজ আর কেউ করে না–মহাসামন্ত সুধীমিত্র সম্মত হয়েছেন, তাঁর নির্মিত মন্দিরে মৃঙ্কলকও থাকবে। তুমি এ সুযোগ হারিও না। সুযোগ পেয়ে সে ধন্য মনে করেছিলো নিজেকে। আশা ছিলো তার, সমস্ত শিক্ষা ও সাধনার ফলকে নিঃশেষে ঢেলে দেবে ঐ মন্দির গাত্রের মৃৎফলকগুলিতে। দেবপীঠে প্রস্তর প্রতিমার পাশাপাশি শোভা পাবে মৃৎফলকগুলিও। যুগান্তরের মানুষ জানবে আত্রেয়ী তীরবাসী শ্যামাঙ্গ নামক এক মৃৎশিল্পীর হাতের কাজ ঐ সুষমাময়ী শবর কন্যা, ঐ প্রণয়দীপ্ত ব্যাধমিথুন, ঐ মমতাময়ী ধীবর জননী আর রামায়ণ কাহিনীর চিত্রময় ফলকমালা। জনক নন্দিনী যেন বা গৃহেরই বনিতা, লক্ষণ যেন নিজেরই অনুজ, শ্রীরামচন্দ্র একান্তই আপন সুহৃদ। সে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছিলো। বসুদেব প্রথমে বাধা দেননি। শিষ্যের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিলো সম্ভবত। কিন্তু তারপর যেন কী হলো–শ্যামাঙ্গের কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখতে আরম্ভ করলেন। প্রথম প্রথম তিনি কিছুই বলেননি। তবে এও মনে হচ্ছিলো, শ্যামাঙ্গকে বোধ হয় আর তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেউ তার কানে কোনো কথা তুলেছিলো কিনা বলা কঠিন। তবে শ্যামাঙ্গের কাজ দেখবার সময় তাঁর ভ্রূর কুঞ্চন রেখা সর্বদাই জাগরূক থেকেছে। অবশেষে এই ব্রাত্য প্রসঙ্গ নিয়ে ঘটনা।
শ্যামাঙ্গের এখন মনে হয়, যে ঘটনাকে আকস্মিক বলে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতপক্ষে তা প্রায় অনিবার্যই ছিলো। প্রশ্নটা তো এসে যাচ্ছিলো দৃষ্টিভঙ্গির। মূর্তি নির্মাণ কেন? শিল্প কেন? এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিলো গুরুদেবকে এবং তার নিজেকেও। আর প্রশ্নগুলি এমনই যে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে নীলাম্বরের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। নীলাম্বর প্রস্তর–শিল্পী, প্রচলিত প্রতিমালক্ষণশাস্ত্র তার ভালোভাবে অধিগত। ছেদনী দিয়ে কঠিন প্রস্তরে সে অতি সূক্ষ্ম কাজটিও সম্পন্ন করতে পারে। বেশ কয়টি বিষ্ণুমূর্তি সে ইতোমধ্যে নির্মাণ করেছে। সে শ্যামাঙ্গের কথা একেবারেই বুঝতে পারে না। বলে, অহেতুক তুমি গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। ভালোভাবে চিন্তা করে দেখো–শিল্প কি? অলঙ্করণ বই তো নয়–যার যা রুচি সেই প্রকারই তো অলঙ্করণ হবে। সেক্ষেত্রে তোমার নাসিকা অনুপ্রবেশ করবে কেন, বলো? গুরুদেব তো ঠিকই বলেছেন। সুধীমিত্র তার মনোমতো বস্তুটিই গ্রহণ করবেন। মনোমতো না হলে সেটা তিনি কেন গ্রহণ করবেন? গুরুদেবকে নিয়োগ করেছেন, এই প্রকাণ্ড কর্মশালা নির্মিত হয়েছে, কত দূর দূর দেশ থেকে বহু অর্থ ব্যয় করে উপাদান সামগ্রী নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রতিদিনই প্রায় বিপুল অর্থ ব্যয়–এ সবের উদ্দেশ্য তো ঐ একটিই–নির্মিত বস্তুটি যেন তাঁর মনোমতো হয়। তাঁর মনোস্তুষ্টি করা ছাড়া গুরুদেবের এক্ষেত্রে আর কী করণীয় থাকতে পারে, বলো?