চৈত্রের অপরাহ্ন বড় ধীর। সূর্য পশ্চিমাকাশে সংলগ্ন, এমন স্থির যে মনে হয় না কখনও নিচে নামবে। স্থানটি নির্জন নয়। অদূরে কয়েকজন গ্রামবাসী কিছু দেখবার জন্য সমবেত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং ঐ স্থান থেকেই একেক সময় সোল্লাস চিৎকার ধ্বনি উঠে আসছে। কৌতূহলী হয়ে সে উঠে বসলো। লক্ষ্য করে দেখলো, স্থানটি নিচু এবং জলাশয়। সম্ভবত পুনর্ভবারই একটি মৃত শাখা। ঐখানেই মৎস্য শিকার হচ্ছে।
পুনর্ভবার মূল স্রোত এখানে বঙ্কিম। নদী খাত যেটি সরল, সেইটিই মৃত। এমন ঘটনা সাধারণত দেখা যায় না। তবে নদীর মতিগতি তো রমণীরই মতো, সুতরাং সেটি বোঝাও মানুষের সাধ্য নয়।
নদীতীরের ভূমি ঢেউয়ের মতো–কোথাও উন্নত কোথাও অবনত। বেলাভূমিতে স্থানে স্থানে বদরীকুঞ্জ–এখন বিগতফল এবং নিষ্পত্র। ইতস্তত মনসাকণ্টক ও দীর্ঘ তৃণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝোপ। শঙ্খচিল উড়ছিলো–দূরে টিট্রিহি টিট্রিহি রবে টিট্রিভ পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গের মনে হলো, চরাচর বড় শান্ত। চৈত্রের নদীস্রোত যেমন, তেমনি এ অঞ্চলের জীবনধারাও।
অবশ্য ওদিকে নদীবক্ষে কোলাহল হচ্ছিলো। কিন্তু সেই কোলাহল চরাচরব্যাপী নিঃশব্দতাকে যেন আরও অধিক প্রকট করে তুলছিলো।
সে লক্ষ্য করলো, যারা স্রোতহীন মৃত নদীর জলকে কর্দমাক্ত করে তুলেছে তারা ধীবর নয়, নিতান্তই সাধারণ গ্রামবাসী। তাদের মধ্যে বৃদ্ধ আছে, যুবক আছে, এমনকি বালক–বালিকারাও রয়েছে। ওদের সোল্লাস চিৎকারই থেকে থেকে কানে আসছিলো। এবং ঐ চিৎকারই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে এই সমবেত মৎস্য শিকার জীবিকার প্রয়োজনে নয়, নিতান্তই আনন্দের কারণে।
সে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। জালপাশ থেকে মৎস্যের উল্লম্ফ পলায়ন, তরুণ ও বালক–বালিকাদের সোল্লাস চিৎকার, নিষিক্ত কৃষ্ণদেহে রৌদ্রের প্রতিফলন–সব একত্রে একটি অসাধারণ দৃশ্য বলে তার মনে হলো। কৌতুক এবং উল্লাস, শক্তি এবং আনন্দ, জল এবং মানবসন্তান–এমন একত্রে আর কখনও তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। সে মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো এবং তার মনে নানান চিত্র মুদ্রিত হয়ে যাচ্ছিলো।
তার মনে হচ্ছিলো যেন একটি দীর্ঘ চিত্রমালা তার চোখের সম্মুখে গ্রথিত হচ্ছে। ঐ সময়ই আবার গুরু বসুদেবের কথা স্মরণ পথে উদিত হচ্ছিলো। বসুদেব তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেননি। বারবার নিষেধ করেছেন। ঘুরে ফিরে এসে দেখেছেন তার কাজ। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দেখো, কোনোভাবেই যেন তোমার ফলকে ব্রাত্য প্রসঙ্গ না থাকে– শাস্ত্রানুশাসন বিচ্যুত হয়ো না।
সে একদিন প্রশ্ন করেছিলো, কেন গুরুদেব, ব্রাত্য মুখচ্ছবিতে অপরাধ কি?
অপরাধ? গুরু বসুদেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিলো। বলেছিলেন, অপরাধের কথা তো বলিনি, বলেছি প্রয়োজনের কথা। মন্দির গাত্রে যে মৃত্তিকাপট থাকবে তাতে পবিত্র ভাবটি থাকা চাই। ম্লেচ্ছ ব্রাত্যের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার না থাকলে তাদের প্রসঙ্গ কেমন করে মন্দির গাত্রের মৃত্তিকাপটে উত্তীর্ণ হতে পারে বলো?
শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারেনি তখনও। জানতে চেয়েছিলো, গুরুদেব, বুঝতে পারছি না, ব্রাত্যজন অপবিত্র হতে পারে, কিন্তু মৃৎপট, কি শিলাপট–এসব তো আর মানুষ নয়, নিতান্তই মৃত্তিকা অথবা শিলা–এসবের আবার পবিত্র অপবিত্র কি?
বসুদেব ঈষৎ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, মূখের মতো কথা বলো না শ্যামাঙ্গ, মৃত্তিকা ও শিলা তো পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বত্র, কিন্তু দেবতার পীঠস্থান কি সর্বত্র? সকল মৃত্তিকাই কি দেবতা হয়, বলো? সকল শিলাই কি দেবতা?
সে বিভ্রান্ত বোধ করছিলো, সে জানতো, গুরু বসুদেব প্রতিমা নির্মাণশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রেও যে তার প্রবল অধিকার এ তথ্য তার জানা ছিলো না। তার বুদ্ধি বিভ্রান্ত হচ্ছিলো–কিন্তু হৃদয় বিভ্রান্ত হয়নি। সেখান থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছিলো। সে নীরব থাকতে পারেনি। বলেছিলো, গুরুদেব, তাহলে দেবতা কী? ভগবান কী? জগত কি দেবসম্ভূত নয়?
এই প্রশ্নে বসুদেব চমকে উঠেছিলেন। সম্ভবত নিদারুণ ব্ৰিত বোধও করেছিলেন। শেষে বলেছিলেন, জটিল তর্ক করো না শ্যামাঙ্গ, দেবতার পীঠস্থান ধর্মসিদ্ধ–তুমি শুধু এইটুকু মনে রাখবে যে ধর্মই সত্য, পরম ব্রহ্মই সত্যব্রহ্মজ্ঞান যার আছে সেই ব্রাহ্মণের নির্দেশই পালনীয়–আর অন্য কিছু সত্য নয়, পালনীয় নয়।
শ্যামাঙ্গের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বসুদেব যা বলেছেন তা তার আদেশ। কিন্তু তবু সে নিজের কথাটি না বলে পারেনি। খুব ধীর কণ্ঠে বিনীতভাবে সে জানিয়েছিলো প্রভু, আমি ইতোমধ্যে মৃঙ্কলকে কিছু মানবী মূর্তি উৎকীর্ণ করেছি।
মানবী মূর্তি? বসুদেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিলো মুহূর্তে। বলেছিলেন, দেবপীঠে মানবী মূর্তি কেন থাকবে? এখনই বিনষ্ট করো, কোন পটে–কোন ফলকে তোমার সেই মানবী মূর্তি, দেখি?
শ্যামাঙ্গকে তখন তার রৌদ্রশুষ্ক ফলকগুলি একে একে দেখাতে হয়েছে। রামায়ণ কাহিনীর চিত্রমালা পরিস্ফুটনের দায়িত্ব ছিলো তার। জানকীর বরমাল্য দান, রামের বনগমন, হনুমানের গন্ধমাদন বহন ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ সে মৃৎফলকগুলিতে উত্তীর্ণ করেছিলো। এবং ঐসব ফলকের সঙ্গে সঙ্গে আরও কটি মানবী মূর্তির ফলকও ছিলো। প্রেমিকের কণ্ঠলগ্না ব্যাধ তরুণীর প্রণয়দৃশ্য ছিলো একটি, একটি ছিলো শবর যুবতীর প্রতীক্ষার দৃশ্য আর ছিলো মাতৃময়ী ধীবর রমণীর সন্তানকে স্তন্য দানের দৃশ্য।