এ গ্রাম ত্যাগ করে কোথায় যাবো বলুন? শ্যামাঙ্গ দেখে, লীলাবতী তার মুখপানে চেয়ে আছে।
শ্যামাঙ্গ মুখখানি দেখলো, চোখ দুটি দেখলো, কেশপাশ দেখলো, তার মুখে তখন আর বাক্য নিঃসৃত হয় না।
কই, বলুন? কোথায় যাবো এই গ্রাম ত্যাগ করে?
শ্যামাঙ্গের যেন সম্বিৎ ফেরে লীলাবতীর কথায়। মুহূর্তের জন্য সে বিভ্রান্ত হয়েছিলো। বললো, যেখানে হোক, চলে যান–এ গ্রাম নিরাপদ থাকবে না।
আপনি দেখছি আমার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়েছেন?
শ্যামাঙ্গ সচকিত হয়। এ কথাও কি বিদ্রূপ? সে বুঝতে পারে না। বলে, আপনার রোষ কি এখনও যায়নি?
না, যায়নি, লীলাবতী উত্তরে জানায়। বলে, আপনার উপদেশের কোনো অর্থ হয়–সমস্ত গ্রাম বিপন্ন হলে আমি কোথায় যাবো, কার সঙ্গে যাবো? আর বিপদ কি শুধু বহিরাগত যবনদের কারণে? কেন, সামন্তপতিদের উপদ্রব নেই? তারা আক্রমণ করে না? বরং আপনাকে বলি, আপনি নিজে সাবধান হন, যে কোনো দিন হরিসেনের অনুচররা এ গ্রামে আসতে পারে–
কথা কটি বলে লীলা চলে গেলো। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শ্যামাঙ্গ।
তার কিছু বলবার নেই, করণীয়ও কিছু নেই। সে যথার্থই কি কাপুরুষ? সমূহ বিপর্যয় আসন্ন উপলব্ধি করেও সে কেবলমাত্র কটি বাক্য ব্যয় ব্যতীত আর কিছুই করতে পারে না? ধিক তোর এই নিবীর্য অস্তিত্বে–তুই কিছুই করতে পারিস না। সন্ধ্যাকালের নির্জন পথে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে ধিক্কার দিতে আরম্ভ করে।
বহির্বাটির কক্ষটিতে শ্যামাঙ্গের শয়নের স্থান হয়েছে। শ্যামাঙ্গ আহারাদির পর শয্যাগ্রহণ করলো। সমস্ত পল্লী অস্বাভাবিক নীরব। মধ্যে মধ্যে কয়েকটি পথকুক্কুর রোদন করে উঠছে। ঐ শব্দ অদ্ভুত লাগে–অজানা ভয় শিহরিত হয় মনে। কে জানে, কোন দুর্যোগ সমান্ন? বাহিরে শুকদেব ও দীনদাসের কথা শ্রবণে আসছিলো। এক সময় ঐ মৃদু আলাপও গেলো নীরব হয়ে। শ্যামাঙ্গ উপাধান দুহাতে আকর্ষণ করে শয়ন করলো এবং তার ক্লান্ত শরীর অচিরেই নিদ্রাভিভূত হয়ে গেল।
বিপর্যয় আরম্ভ হলো মধ্যরাতে। প্রথমে কিছুই বোঝা যায়নি। দূরে রুহিদাসের গৃহ থেকে যখন চিৎকার ওঠে–তখনও শ্যামাঙ্গ নিদ্রামগ্ন। ক্রমে পল্লীবাসীরা দ্রুতপদে বনভূমি লক্ষ্য করে পলায়ন আরম্ভ করলো। দুটি একটি গৃহে যখন অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়েছে তখনও শ্যামাঙ্গের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। অকস্মাৎ সে অনুভব করে, কেউ তার কক্ষদ্বারে সজোরে করাঘাত করছে। সে জেগে উঠে বসলে মুহূর্তেক পরই চিৎকার এবং আর্তনাদ শুনতে পায়। দ্বার অর্গলমুক্ত করতেই লীলাবতী কক্ষে প্রবেশ করে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, শীঘ্র পলায়ন করুন, বিলম্ব হলে প্রাণ হারাবেন।
শ্যামাঙ্গ বাইরে এসে বললো, মায়াবতীরা কোথায়?
লীলাবতী তার হাত ধরে জানায়, তারা বনভূমির দিকে গেছে, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, কথা বলবেন না।
এদিকে ততক্ষণে সমগ্র পল্লীটি জ্বলে উঠেছে। কাদের এই কাজ, কিছুই বোঝ যাচ্ছিলো না। দূরে তরবারি হস্তে বীর ধটিকা পরিধানে কিছু লোককে দেখে অনুমান করা গেলো, এরা আর যাই হোক, দস্যু নয়। দুজনে অগ্রসর হতে গেলেই বাধা পায়, সম্মুখে একটি বৃদ্ধকে প্রহার করা হচ্ছে। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে–আজ তবে এখানেই ইহলীলা সাঙ্গ করতে হবে। লীলাকে বলে, তুমি অগ্রে যাও–আমি তোমার পশ্চাতে আসছি। লীলা সজোরে শ্যামাঙ্গের বাহু ধরে রাখে। বলে, ওভাবে পারবেন না, পশ্চাতে যাই চলুন।
পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখা গেলো, লীলাবতীদের গৃহ জ্বলছে।
না এদিকে না, সম্মুখেই চলুন, লীলা ধাবিত হলো।
অন্ধকার, ধূম, অগ্নিশিখা এবং আক্রমণকারীদের সোল্লাস চিৎকার। ঐ যে পলায়– ধর ধর–বলে দুজন শ্যামাঙ্গের পশ্চাতে অনুসরণ করে। লীলাবতীর সাধ্য কি যে বলশালী সৈনিকদের পশ্চাতে ফেলবে। তারা লীলাকে ধরতে উদ্যত হওয়া মাত্র শ্যামাঙ্গ একখানি প্রজ্বলিত বংশদণ্ড দুহাতে তুলে নিলো। ওদিকে দুজনের হাতেই রক্তাক্ত তরবারি। ঐ তরবারি দুখানির বিরুদ্ধে বংশদণ্ডটি আর এমন কি অস্ত্র! লীলা, তুমি চলে যাও–শ্যামাঙ্গ চিৎকার করে। কিন্তু ঐ চিৎকার লীলাবতীর শ্রবণে যায় কি না অনুমান করা কঠিন। সৈন্য দুটি তখন ভয়ানক হাসি হাসছে। শেষ আঘাত একেবারেই আসন্ন। শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত হলো–জীবন, তোমাকে বিদায়!
কিন্তু ঐ মুহূর্তেই আবার ধাবমান অশ্বের খুরধ্বনিও শোনা গেলো। ধূম এবং অগ্নিশিখার প্রক্ষিপ্ত প্রতিফলনে দ্রুতগতি ছায়ার মতো অশ্বারোহীদের আগমন নির্গমন দেখা যেতে লাগলো। এই অশ্বারোহীদের কারও হাতে উন্মুক্ত তরবারি, কারও হাতে সুদীর্ঘ শূলদণ্ড, কারও হাতের দীর্ঘদণ্ডে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। এরাই কি পল্লীটিকে ভস্মীভূত করতে চায়? দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুময় মুখমণ্ডল, মস্তকে উষ্ণীষ–না, কোনো সন্দেহ নেই–এরাই সেই যবন দল। শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত হয়।
সৈন্য দুটি যেমন, তেমনি শ্যামাঙ্গও বিমূঢ় দৃষ্টিতে ইতস্তত ধাবমান অশ্বারোহীদের দেখছিলো। ঐ সময় একজনকে সম্মুখে অগ্রসর হতে দেখে সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করলো। এবং তারপরও ওদের পশ্চাতে একজন অশ্বারোহীকে ধাবমান হতে দেখা গেলো।
লীলা তার হাত ধরে আকর্ষণ করে, চলুন, মূখের মতো দাঁড়াবেন না।
কিন্তু বারেবারেই দাঁড়াতে হলো দুজনকে। দেখলো, তরবারির আঘাতে বালকের ছিন্নমুণ্ড কেমন ভূমিতে গড়িয়ে পড়ে, শূলাঘাতে বৃদ্ধ কিভাবে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে মরণ চিৎকার কণ্ঠ থেকে নির্গত করে, ধাবমান অশ্বের পদাঘাতে রমণী মস্তক কিভাবে চূর্ণিত হয়। সমস্তই দেখলো দুজনে। এবং ঐসব দৃশ্য দেখতে দেখতে বনভূমির প্রান্তে উপনীত হলো তারা। সেখান থেকেই লীলাবতী চিৎকার করে পিতাকে ডাকতে লাগলো। সে তখন উন্মাদিনীপ্রায়–পিতার সন্ধান করছে, মাতুলের সন্ধান করছে, সখী মায়াবতীর সন্ধান করছে। সে জানে না, কে আছে, আর কে নেই। শ্যামাঙ্গ তখনও প্রজ্বলিত, লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত পল্লীটির দিকে চেয়ে আছে। তার মনে কেবলই প্রশ্ন, এরা কারা? একই স্থানে আঘাত হানে, একই গৃহে অগ্নি দেয়, একই পল্লীর মানুষকে হত্যা করে–অথচ দুটি ভিন্ন দল–এদের মধ্যে কি সত্যিই কোনো পার্থক্য আছে?