লীলাবতীর ক্রোড়ে মাথাটি রেখে মায়াবতী কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললো, সখী, এ আমার কি হলো?
লীলাবতী সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায় না। স্বামীর সুখে বড় সোহাগিনী হয়েছিলো মায়াবতী। সেই স্বামী তার হারাবার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় সান্ত্বনা বাক্য উচ্চারণ করার কি কোনো অর্থ হয়?
সে বলতে পারে, সখী দুশ্চিন্তা করিস না, তোর স্বামী অবশ্যই ফিরে আসবে–কিন্তু কথাটা কি সত্যি হবে? কে না জানে, বসন্তদাস ভিক্ষুদলের লোক। তাকে সন্ধান করে ফিরছে হরিসেনের লোকেরা। এ অঞ্চলে কোথাও দেখতে পেলেই ওরা বসন্তদাসকে বন্দী করবে। আর একবার ওদের হাতে বন্দী হলে কোনো লোক অক্ষত দেহে ফিরে এসেছে, এমন সংবাদ কারও জানা নেই।
লীলাবতী সখীর মাথায় হাত রাখে। তার রুক্ষ কেশদামে অঙ্গুলি চালনা করে পরম মমতা ভরে। তার মনে হয়, জীবন তাহলে এইরূপই–খণ্ডিত, বিকৃত, প্রতারণাময় এবং হিংস্র। সুখী সংসার বলে জগতে কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। সংসারে সুখনীড় রচনা করবার কথা তার, কিন্তু ঘটনা এমন ঘটলো যে, সংসারই তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো–অথচ তার কোনো অপরাধ ছিলো না। আর সখী মায়াবতী! কদিন পূর্বেও যে ছিলো সংসারবৃন্তে প্রস্ফুটিত কুসুমটি, আজ দেখো, তার কী অবস্থা, সে কেমন ধূলিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে–তারও কোনো অপরাধ নেই, তাহলে?
সে বললো, সখী, কাঁদিস না–জীবন বিরূপ হয়ে উঠেছে বলে কি তুই তাকে পরিত্যাগ করবি? বরং ওঠ তুই, আয় আমরা শেষ অবধি দেখি, জীবন আমাদের জন্য কিছু দান করতে পারে কি না।
কথা দুটি সে বললো এই জন্য যে এ ছাড়া তার বলবার কিছু ছিলো না। নিজের অতীত বর্তমান সে একত্রে দেখতে পাচ্ছিলো। এক অদৃশ্য বিধানের নিগড়ে আবদ্ধ সবাই। কেবলি ভয়, কেবলি নিষেধ, কেবলই হতাশা। পিতৃগৃহে দেখছে, স্বামীগৃহে দেখছে, মাতুলালয়ে দেখছে–সর্বক্ষেত্রেই জীবন পিষ্ট, সঙ্কুচিত এবং বিবর্ণ। আশা করার কিছুই নেই কারও—কেননা আশা কখনই ফলবতী হয় না। সুতরাং কেবলই চেষ্টা, কোনো প্রকারে যেন বেঁচে থাকা যায়–জীবনের ধর্মে পারা যায় না, সহজ স্বাভাবিকতায় পারা যায় না, কিন্তু তবু বাঁচতে হবে–কৌশলে হোক, ছলনা করে হোক, আত্মপ্রতারণা করে হোক। এমন ক্লান্তিকর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার নামই কি তাহলে জীবন? সে চিন্তা করে কূল পায় না।
সন্ধ্যাকালে নদীতীরে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর সাক্ষাৎ লাভ করলো। লীলাবতী তার মেষ শাবকটি নিয়ে গৃহে ফিরছিলো। বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গ ডাকলো, লীলাবতী!
লীলাবতী ঐ ডাক শুনে স্থির হলো মুহূর্তেক, পরক্ষণেই আবার সে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়ে চললো। শ্যামাঙ্গের ডাক সে উপেক্ষা করতে চায় বলে মনে হলো। শ্যামাঙ্গ আবার ডাকলো, লীলা–আমি আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলতে চাই।
লীলা এবার দাঁড়ায়–এটিও বৃক্ষতল, এবং নিবিড় ছায়া এখানে।
আমি দুঃখিত লীলা, আম্রপট্টলী গ্রামে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কেন? লীলাবতী কুণ্ঠাবনত পুরুষটির মুখ পানে চায়।
পথিমধ্যে দস্যু আক্রান্ত হয়ে আমি সর্বস্ব হারিয়েছি।
আহা! দুঃখের কথা! লীলা ক্ষুদ্র মন্তব্য করে।
আপনি বিদ্রূপ করতে পারেন, কিন্তু আমি যা বলছি, তার কণামাত্র মিথ্যা নয়।
আর কি কোনো কথা আছে সত্যবাদী পুরুষটির? লীলাবতীর কণ্ঠস্বর এবার গম্ভীর এবং অবিচলিত। জানায়, আমার কাজ আছে, গৃহে আজ অতিথি।
লীলা পদক্ষেপণ করলে শ্যামাঙ্গ বলে, আপনি কোন কারণে আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন জানি না, তবে একটি কথা আপনাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করি–আমি আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা অবশ্যই পালন করবো।
লীলা আপন মনে যেন হাসে। অতঃপর জানায়, উত্তম কথা, আপনার ভবিষ্যৎ চেষ্টার জন্য পূর্বাহেই ধন্যবাদ। তবে জেনে রাখুন, যার সন্ধানে আপনি যাবেন, তিনি এখন সেখানে নেই–তিনি সামন্ত হরিসেনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন–কি, পারবেন সেখান থেকে তাঁকে আনতে?
শ্যামাঙ্গের বুঝতে কষ্ট হয় না, কেন এই ক্ষোভ। লীলাবতীর শ্লেষতীক্ষ কথা তাকে বিলক্ষণ বিদ্ধ করলে সেও লীলাবতীকে জানায়–তাহলে তো আপনি এখন রাজপুরুষের গৃহিণী–আমাদের ভক্তি ও ভয় উভয়ই আপনার প্রাপ্য।
হ্যাঁ, আপনার দেখছি বুঝবার ক্ষমতাটি তীক্ষ্ণ–এখন থেকে বুঝে কাজ করবেন।
সে না হয় করবো, শ্যামাঙ্গ যেন সম্মত হয়। তারপর বলে, কিন্তু একটা কথা কি শুনেছেন?
না বললে কেমন করে শুনবো?
তাহলে শুনুন, অতি শীঘ্রই দুর্ধর্ষ এবং হিংস্র যবন জাতি এদেশে আসছে, ওরা এলে কিন্তু রাজপুরুষদের সত্যি সত্যিই যুদ্ধ করতে হবে–সে বড় কঠিন কাজ হবে তখন।
লীলাবতীর স্বরে আর বিদ্রূপ ধ্বনিত হয় না। সে ধীর পদে কাছে এগিয়ে আসে। বলে, এ সংবাদ আপনি কোথায় পেলেন? সত্যি সত্যিই কি যবন জাতি এদেশে আসবে?
সত্যি-মিথ্যা জানি না, শ্যামাঙ্গ জানায়, আপনাদের গৃহে যে যযাগীটি অতিথি, সে–ই সংবাদটি নিয়ে এসেছে।
এদিকে আবার কুম্ভকার রুহিদাসের পুত্রটিকে নিয়ে যে কাণ্ডটি ঘটেছে তাতে সকলেরই ভয়–সেই পিপ্পলী হাটের মতো কিছু ঘটে না যায়–লীলাবতী চিন্তিত স্বরে জানায়।
শ্যামাঙ্গ দেখলো, এখন লীলাবতী আর চপল নয়, তার স্বরে এখন বিদ্রূপ নেই, ক্রোধ নেই। সে বললো, সাবধানে থাকবেন–প্রয়োজন বোধ করলে এ গ্রাম ত্যাগ করুন– অহেতুক লাঞ্ছিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।