বিশ্বাসঘাতক, শ্যামাঙ্গ ক্রুদ্ধ মন্তব্য করে।
বন্ধু উত্তেজিত হয়ো না, সকল কর্মের নিজস্ব যৌক্তিকতা থাকে–ঐ ভিক্ষুটিও সম্ভবত তার কর্মের যৌক্তিকতা দেখাতে পারবে। শুনতে পেয়েছি তনকূলের তুর্কি কেন্দ্র থেকে এই পক্ষকালের মধ্যেই একটি অশ্বারোহী দল উজুবট গ্রাম অভিমুখে আগমন করবে।
কেন, সেখানে কি হয়েছে? শ্যামাঙ্গ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।
জানি না, যোগীটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে। বলে, আমি এই সংবাদটিই গুরু সিদ্ধপার কাছে জানাতে চাই।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অবশেষে উজুবটে প্রবেশ করে শ্যামাঙ্গ। সঙ্গে যোগীটি থাকায় পথিমধ্যে সকলেই তাদের প্রতি তির্যক দৃষ্টিপাত করছিলো। কিন্তু শ্যামাঙ্গের সেদিকে মনোযোগ ছিলো না। সে মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। দ্রুত পদক্ষেপে সে অগ্রসর হচ্ছিল। মনে কেবল একটি চিন্তা, কখন শুকদেবের গৃহে সে উপনীত হবে।
১০. শুকদেবের গৃহ নীরব
শুকদেবের গৃহ নীরব। বেলা দ্বিপ্রহর, কিন্তু জনমানব কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সে ক্ষণেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। তাতে বিচিত্র একটি ভাব তার উপলব্ধি হয়। মনে হয়, নীরব পল্লীটিতে বিষাদ এবং হতাশা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। তার কাছে পরিবেশটি অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য লাগে। সে একটি রাখাল বালককে ডাকলো। বালকটি সংবাদ দিতেই শুকদেব বাইরে এলেন। ক্ষণেক পর দীনদাসকেও দেখা গেলো। যোগীটিকে দেখে দীনদাস বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো। বললেন, যোগী মহাশয় কি এই গ্রামেই অবস্থান করবেন?
শ্যামাঙ্গ অবাক হয়। দীনদাসের ব্যবহার তো পূর্বে কখনও রূঢ় দেখেনি সে? এই অল্প কদিনে এমন কী ঘটলো যে
মহাশয়, শুকদেব জানান, আপনি বরং অন্য পল্লীতে যান, আমরা এই পল্লীবাসীরা, বর্তমানে বিপদগ্রস্ত আছি।
দুজনের কেউই শ্যামাঙ্গকে কিছু বলেন না।
শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় এবং হতবাক। এমন আচরণ কেন করলেন এঁরা? কী বিপদ এঁদের যে বহিরাগত একজন সংসার ত্যাগী যোগীপুরুষকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না? শ্যামাঙ্গ অধিক বাক্য ব্যয় আর করলো না। যোগীগুরু সিদ্ধপাকে কোথায় পাওয়া যাবে–শুধু এই সন্ধানটুকু সে প্রৌঢ় দুজনের কাছে জানতে চাইলো।
দীনদাস সম্মুখে হাত তুলে নির্দেশ করলেন, ঐ যে, ঐ গৃহে যাও।
শ্যামাঙ্গের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঐ গৃহ তো লীলাবতীদের। ঐ গৃহে যে একজন সিদ্ধ যোগী থাকেন–এ সংবাদ তো কেউ তাকে পূর্বে দেয়নি।
সঙ্গী যোগীটি নির্দিষ্ট গৃহাভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গকে শুধু বললো, আমি গুরুদেবের কাছে যাই।
দীনদাস জানতে চাইলেন, এই লোকটি লীলাবতীর মাতুলের কাছে কেন এসেছে, জানো?
শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে, লীলাবতীর মাতুলই তাহলে যোগী সিদ্ধপা। বলে, না আমাকে সে কিছু বলেনি, শুধু জানি, সে সিদ্ধপার শিষ্য এবং তার নিবাস পশ্চিমে।
যোগমায়া সম্মুখে এলে শ্যামাঙ্গ তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। সে লক্ষ্য করে, মাতার মুখখানি বিষাদময়।
সে জানতে চাইলো, মাতঃ, মায়াবতাঁকে যে দেখছি না।
ঐ কথায় যোগমায়ার রুদ্ধ আবেগ উদ্বেল হয়ে উঠলো। বললেন, হতভাগিনী বাইরে আসবে না বৎস, তার বড় দুর্ভাগ্য এখন।
অতঃপর যোগমায়াই বললেন–খণ্ডে খণ্ডে, ইতস্তত, পূর্বাপর সঙ্গতিবিহীন, তবু তিনি বললেন, আর তিনি বললেন বলেই শ্যামাঙ্গ ঘটনাগুলি জানতে পারলো।
বৎস, বড় দুর্ভাগ্য আমাদের, জামাতার সন্ধানে প্রতিদিন সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন করে লোক আসছে–জামাতা গৃহত্যাগ করেছে–কবে ফিরবে, কিছুই বলা যায় না। এদিকে আবার বালকদের খেলাধুলার সময় দণ্ডগুলির একটি গুলি মস্তকে লেগে এক জ্ঞানার্থী ব্রাহ্মণের রক্তপাত ঘটায় ভয়ানক একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এ স্থানে এ পল্লীতে ভিক্ষু আর যোগীদের সন্ধান করছে গূঢ়পুরুষেরা–কী অঘটন ঘটবে ভবিষ্যতে, কে জানে–আমরা সম্মুখে অন্ধকার দেখছি, তুমি বৎস, বড় দুর্দিনে এলে।
আমার জন্য চিন্তা করবেন না মাতঃ, শ্যামাঙ্গ জানায়, দুর্দিন সুদিন উভয়ই আমার কাছে একরূপ।
লীলাবতী গৃহদ্বার থেকে যোগীটিকে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলো। মাতুল শিষ্যকে দেখে প্রীত হলেন। অতঃপর দুজনে একটি কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। লীলাবতীর কৌতূহল হয়েছিলো সামান্য–হয়তো সে ঐ দুজনের আলাপ শুনবার চেষ্টাও করতো–কিন্তু ঐ সময়ই সে মায়াবতীদের গৃহদ্বারে শ্যামাঙ্গকে দেখতে পায়। প্রথম দৃষ্টিতেই সে বিচিত্র একটি স্পন্দন অনুভব করে নিজ রক্তধারায়। ফলে তার ক্রোধ হয়। নিজের উপর, না শ্যামাঙ্গের উপর তা অবশ্য সে স্থির জানে না। কিন্তু ইচ্ছা হয়, একবার লোকটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতে। সে জানে, শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হওয়ার আর তার প্রয়োজন নেই। কারণ আম্রপট্টলীর যে সংবাদ জানবার জন্য শ্যামাঙ্গকে তার প্রয়োজন ছিলো, সেই সংবাদ তো তার মাতুল এনে দিয়েছেন। অভিমন্যু দাস আম্রপট্টলীতে নেই, সে সামন্ত হরিসেনের সেনাদলে যোগ দিয়েছে। সুতরাং কোন যুক্তিতে সে এখন শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হবে? লীলাবতী বার দুই শ্যামাঙ্গকে দূর থেকে দেখলো। আর দুইবারই তার মনে হলো, লোকটা প্রতারক, ভণ্ড এবং কাপুরুষ।
লীলাবতী মায়াবতীদের গৃহে এলো অপরাহ্নে। তখনও মায়াবতী ভূমিতে শয়ান। লীলাবতীকে দেখে বললো, আয় এখানে উপবেশন কর।