ঐ সময় সমস্বরে চিৎকার আরম্ভ হয় নৌকা থেকে। তাতে শ্যামাঙ্গ সচকিত হয়। বলে, আপনার সঙ্গীরা ওদিকে বড় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
হ্যাঁ, যাই আমি, প্রৌঢ় পশ্চাতে দেখে নিলেন বারেক। তারপর বললেন, বৎস, এটি তুমি রাখো, পথে তোমার প্রয়োজন হতে পারে।
প্রৌঢ় পথিক চলে গেলেন। জয় গঙ্গা মাতা বলে নৌকাটি ভাসলো স্রোতের অনুকূলে। প্রৌঢ় প্রদত্ত বস্ত্রখণ্ডে কুণ্ডলীকৃত বস্তুটি হাতে নিয়ে শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নৌকাটি দৃশ্যের বাইরে চলে গেলে তার সম্বিৎ ফিরলো। তখন সে কুণ্ডলীকৃত বস্ত্রখণ্ড খুলে দেখলো। অবাক হবার মতোই ব্যাপার। মাত্রই দণ্ড দুতিনের পরিচয়। কিন্তু তবু এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তার শুশ্রূষা করেছেন, সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন সুস্থ করে তুলতে–তদুপরি আবার এই দান! দেখলো বস্ত্রখানি উত্তরীয় এবং তারই এক কোণে গ্রন্থিবদ্ধ কয়েকটি মুদ্রা। তার মনে হলো এই দান স্নেহধন্য। সে পরম শ্রদ্ধাভরে দান গ্রহণ করলো।
কি বিচিত্র এই সংসার। কোথাও সে বিতাড়িত হচ্ছে। আবার কোথাও তাকে স্নেহডোরে বাঁধবার জন্য ব্যাকুল বাহু প্রসারিত হয়ে আছে। তার ইচ্ছা হলো প্রৌঢ় পথিকের গ্রামে গিয়ে কন্যাটিকে দেখে আসে একবার। আহা কি আকুল প্রতীক্ষায় দণ্ড পল অনুপল কাটছে বালিকাটির। বালিকা না তরুণী সে কিছুই জানে না। এ কিসের প্রতীক্ষা করছে তরুণীটি–জীবনের না মরণের? শবরীর প্রতীক্ষার কাহিনীটি তার মনে পড়ে। একটি মৃত্যলকে চিত্রটি সে উত্তীর্ণও করেছিলো। কিন্তু হায়, গুরু বসুদেব বুঝতে চাইলেন না।
সে ধীরপদে নদীতীর ধরে অগ্রসর হলো। যে বালক দুটি দণ্ডগুলি নিয়ে খেলছিলো তারা শ্যামাঙ্গকে দেখেও যেন দেখলো না। শ্যামাঙ্গ যখন জানতে চাইলো, বাপু হে, তোমাদের নিবাস কোন গ্রামে? তখন সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে তারা শ্যামাঙ্গের আপাদ মস্তক দেখে নিলো। অতঃপর একটি বাক্যও ব্যয় না করে হাত তুলে এমন একটি দিক নির্দেশ করলো যেটি পূর্ব–পশ্চিম, উত্তর–দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব–অধঃ সব দিকই হতে পারে।
পথক্রমণ করতে করতে সে অনুভব করলো শরীরে এখনও তার অবসাদ, সর্বাঙ্গে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সূর্য এখন মুখোমুখি। দেখে মনে হচ্ছে, পশ্চিমাকাশে একখানি উত্তপ্ত তাম্রস্থালী কেউ যেন সংলগ্ন করে রেখেছে।
তার কেবলি মনে হতে লাগলো নীলাম্বর তাকে ভুল পথের সন্ধান দিয়েছে। সে বলেছিলো, পুনর্ভবা তীরের নবগ্রাম হাটে গিয়ে উপনীত হলে তখন আর সমস্যা থাকবে না তোমার। কিন্তু কোথায় সেই নবগ্রাম হাট? সে জানে, নবগ্রাম হাটে আত্রেয়ী তীরের অনেক গো শকট আসে। আত্রেয়ী তীরে একবার পৌঁছাতে পারলে তখন গৃহ গমন তো এক দণ্ডের ব্যাপার।
সে নদীতীর ধরে অনেকখানি পথ অতিক্রম করে। কিন্তু না, কোনো কোলাহল তার কানে আসছে না। পথে লোকই নেই–কোলাহল করবে কে? কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হলে পথিমধ্যে সে একটি তরুণীর সাক্ষাৎ পায়। তরুণীটি একটি গাভীকে তাড়না করে নিয়ে যাচ্ছিলো। তাকে দেখে শ্যামাঙ্গ দাঁড়ালো। ইতস্তত হচ্ছিলো, কিন্তু জিজ্ঞাসা না করেও পারলো না। সে খুবই বিনয়ের সঙ্গে দুহাত জোড় করে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে বললো, ভদ্রে, আমার নমস্কার গ্রহণ করুন। আপনি বলতে পারেন, এই গ্রামের নাম কি?
তরুণীটি অপাঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো চকিতে, তারপর বললো, মরণ! নাটগীতের আর স্থান পাওনি?
দেখুন, আমি দূরের লোক, এ অঞ্চলের পথঘাট কিছুই চিনি না।
পথের রমণীকে তো ঠিক চিনতে পারেন দেখছি।
ঐ তীক্ষ্ণ মন্তব্যে শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে এ অঞ্চলের রমণীরা ক্ষুরধার জিহ্বার অধিকারিণী। প্রয়োজন নেই বাপু তোমাদের সঙ্গে কথার–তোমাদের খুরে দণ্ডবৎ একশতবার, মনে মনে এই বলে সে পুনরায় সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলো।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটবার পর অতিশয় ক্লান্তি বোধ হয়। অবশেষে শ্যামাঙ্গ একটি বটবৃক্ষের নিচে মৃত্তিকা বেদীতে প্রথমে উপবিষ্ট ও পরে অর্ধশয়ান হলো। তার সন্দেহ হতে লাগলো, নবগ্রাম হাট নিশ্চয়ই দূরে। নীলাম্বর শূকরপুত্রটা তাকে এভাবে বিপদে ফেলবে, কল্পনাও করা যায় না।
বিল্বগ্রাম থেকে প্রত্যুষেই সে বেরিয়ে এসেছিলো। কেননা গুরু বসুদেব যা করেছেন তারপর সেখানে থাকবার, কি বিলম্বের, কোনই অবকাশ ছিলো না। বিগ্রাম থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার সময় নীলাম্বর বলে দিয়েছিলো–বন্ধু, তুমি পথ ধরে গেলে দুতিন দিন সময় লাগবে, আবার পরিশ্রমও হবে। বরং তুমি প্রান্তরে নেমে যেও–পশ্চিমে পুনর্ভবা তীর, মাত্রই ক্রোশ তিনেক পথ–সেখানে নবগ্রাম হাটে তুমি আত্রেয়ী তীরের শকট পাবে।
সেই কথা শুনে এই অবস্থা তার। প্রাণ চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিলো না। সে তো রৌদ্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলো। যদি পথিকের দলটি না দেখতে পেতো তাকে–তাহলে ঐভাবে জ্ঞানহারা অবস্থাতেই তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে। যেতো! পরিশেষে তার শরীর ভক্ষ্য হতো শকুন এবং শৃগালের।
নদী এখানে বঙ্কিম। তীরে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। শ্যামাঙ্গ তীর ত্যাগ করে পথে উঠলো। অদূরে একটি বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ এবং তলে মৃত্তিকাবেদী। বেদী না বলে মণ্ডপ বলাই সঙ্গত–বিস্তৃত চত্বরের মতো একেবারে। শ্যামাঙ্গ সেখানে গিয়ে উপবেশন করলো। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছিলো। বারেক ইচ্ছা হলো নদীর জল পান করে আসে। কিন্তু এমন আলস্য তাকে পেয়ে বসলো ঐ মুহূর্তে যে সে উঠলো না। বরং আরও অলস ভঙ্গিতে অর্ধশয়ান হলো।