কেন, কি হয়েছে? শ্যামাঙ্গ ঈষৎ শঙ্কা বোধ করে, কারণ মনোহরদাসের মুখ অতিশয় গম্ভীর ঐ সময়।
মনোহরদাস জানায়, এ কি গোয়ালিনী মূর্তি হয়েছে, তুমিই বলো?
শ্যামাঙ্গ তখন মনোযোগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এবং চকিতেই বিমূঢ় হয়ে যায়। এ কে? এ কার মূর্তি? ক্ষুদ্র পুত্তলি–কিন্তু ভঙ্গিটি অবিকল ধরা পড়েছে–রমণীর গমনভঙ্গি ওটি–দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ, গ্রীবাটি ঈষৎ বঙ্কিম, দক্ষিণপদ সম্মুখে প্রসারিত। রমণীটিকে এবং নিজ মনের একটি দিক একত্রে আবিষ্কার করে সে মরমে মরে গেলো। ছি ছি–এ কোন চিত্র তার অন্তরে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে চিরকালের জন্য? এ তো অবিকল লীলাবতী, উজুবট গ্রামের লীলাবতী!
সে মনোহরদাসকে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে কি পুত্তলিগুলি বিনষ্ট করতে হবে?
না, তা নয়, চিন্তিত মুখে বলেন মনোহরদাস, পুত্তলি অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে, আমার চিন্তা হচ্ছে, এই পুত্তলি অধিক সংখ্যায় বিক্রয় হবে কিনা–ক্রেতারা তো গোয়ালিনী চাইবে তোমার কাছে–এ কি গোয়ালিনী? যদি গোয়ালিনী না হয়, তাহলে বলো, এর নাম কি দেবে? মালিনী?
নাম? শ্যামাঙ্গ এই দিকটি কখনই চিন্তা করেনি। সে বললো, নাম যে কুলসূচক হতেই হবে, এমন কি কোনো বিধান আছে? নাম তো ব্যক্তির পরিচায়ক চিহ্ন মাত্র। যে কোনো নাম দিলেই হয়।
বলল, কি নাম দেবে? মনোহরদাস আগ্রহভরে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চান।
শ্যামাঙ্গের মনে তখন একটি নামই উচ্চারিত হচ্ছে। বললো, ওর নাম দিন লীলাবতী!
লীলাবতী! মনোহরদাস ক্ষণেক চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, উত্তম–তাই হোক, এই নতুন পুত্তলির নাম হোক লীলাবতী।
শ্যামাঙ্গ মনোহরদাসকে সন্তুষ্ট করলো বটে, কিন্তু নিজ বিবেকের নিকট সে অপরাধ বোধ করতে লাগলো। নিজ মনের এ কি রূপ দেখছে সে? কখন লীলাবতী এমনভাবে তার মানস লোকে স্থান করে নিয়েছে, সে জানতেও পারেনি। শোণিত ধারার প্রবাহ কি মানুষ জানতে পারে? লীলাবতী কি তাহলে তার শোণিত ধারার মধ্যে মিশে গিয়েছে? সে কি মিশেছে তার শ্বাসে–নিঃশ্বাসে? তার স্বপ্নে? কল্পনায়?
ছি ছি, এ কী হলো? ধিক তোকে শ্যামাঙ্গ? শতবার ধিক তোকে–বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!
নিজেকে শ্যামাঙ্গ ধিক্কার দেয়। হ্যাঁ বিশ্বাসঘাতকতাই তো সে করেছে। লীলাবতীর কাছে সে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে যে তার স্বামী অভিমন্যু দাসকে এনে দেবে? আর সে নিজেই কিনা হয়ে পড়লো আসক্ত? ছি ছি, ছি ছি, শ্যামাঙ্গ বিবেক দংশনে অস্থির হয়ে ওঠে।
কিন্তু এসবই বালির বাঁধ–ক্ষণে থাকে, ক্ষণে থাকে না। বরং ঐ প্রকার বিবেক দংশন তার আবেগকে অধিকতর উদ্দীপ্ত করে তুললো। যোগীটির পীড়াপীড়ি উপলক্ষ মাত্র–এমনকি মায়াবতীর মাকে প্রণাম করার ইচ্ছাটিও উপলক্ষ বই অন্য কিছু নয়। সে যোগীটির সঙ্গে উজুবটের দিকে যাত্রা করলো।
পথে দুজনায় নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ। উজুবট গ্রামে কোনো সিদ্ধা বা যোগী আছে। এমন সংবাদ শ্যামাঙ্গ পূর্বে কখনও পায়নি। শুনলো, ঐ গ্রামে যোগী গুরু সিদ্ধপা অবস্থান করছেন। সিদ্ধপা অসাধারণ শক্তিমান যোগী–যোগবলে তিনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন। চক্ষুর নিমেষে তিনি ত্রিভুবন ভ্রমণ করেন, সর্প–মারী–ভয় তাকে দেখে শতহস্তেন দূরাৎ পলায়ন করে–আরও আশ্চর্য, আকাশচারী দেবগণ পর্যন্ত অনুমতি ব্যতিরেকে তার উপর দিয়ে গমনাগমন করতে পারেন না–তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় ভক্ত।
নির্জন পথের সঙ্গী দীর্ঘ পথক্ৰমণকালে স্বভাবতই বন্ধু হয়। তদুপরি যাত্রা যদি হয় পদব্রজে, তাহলে তো কথাই নেই–শয়ন গৃহের বিশ্রম্ভালাপের বিবরণ পর্যন্ত পরস্পরের নিকট অজানা থাকে না। যোগীটি নিজ গুরুর প্রশস্তি আরম্ভ করে। এবং ঐ প্রসঙ্গেই নানান বিষয় এসে যায়। যেমন পশ্চিম দেশে মাৎস্যন্যায় আরম্ভ হয়ে গেছে। এক যবন দলপতি রাজপুরুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে–রাজা কোথায়, কেউ জানে না। এই যবন জাতি অশ্বারোহণে অত্যন্ত দ্রুতগতি–আর অস্ত্রচালনায় যন্ত্রবৎ। হিংস্রতায় একেকজন যমের অনুচর। তাদের রক্তপিপাসা কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না এবং নরমুণ্ড দিয়ে তারা গেণ্ডয়া খেলে থাকে।
শ্যামাঙ্গ এই যবন জাতি সম্পর্কে শুনেছিলো শুকদেব ও দীনদাসের কাছে। শুনেছিলো এদের মধ্যে একশ্রেণী আছে যারা সজ্জন এবং বিনয়ী। সে বললো, কিন্তু আমি তো শুনেছি যবনেরা ভদ্র, বিনয়ী এবং সজ্জন, তারা কি সত্যিই নিষ্ঠুর?
যোগীটি ঐ কথায় হাসে। বলে, আপনাকে কি বলবো, স্বচক্ষে দৃষ্ট ঘটনাকে তো আর মিথ্যা বলতে পারবো না–মহানন্দা তীরবর্তী দুইখানি গ্রাম তারা ধূলিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আপনাদের প্রত্যয় হয়তো হবে না, কিন্তু অপেক্ষা করুন, স্বচক্ষেই দেখবেন ওরা এদেশেও আসছে।
সে কি? শ্যামাঙ্গ অবাক হয়ে যায়। মুখে বাক্য নিঃসৃত হয় না পক্ষ দুই আগে শুকদেব যে বলেছিলেন কোনো ঘটনাই কার্যকারণ ব্যতিরেকে ঘটে না–তাহলে যবন জাতির আগমনের এইটিই কি তাৎপর্য? সে বলে, আপনি কি প্রকৃত সংবাদ জানেন যে যবনেরা পুনর্ভবার পূর্বতীরেও আসছে?
যোগী ঐ কথার উত্তরে সহসা কিছু বলে না। পরে জানায়, বন্ধু শ্যামাঙ্গ, যদি চক্ষু উন্মীলিত রাখো, তাহলেই বুঝতে পারবে, পরিস্থিতি কিরূপ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এদেশে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের উপর অত্যাচার ও লাঞ্ছনা আমরা আবাল্য দেখে আসছি উপরন্তু এখন আরম্ভ হয়েছে প্রজাপুঞ্জের উপর অত্যাচার। রাজশক্তি প্রজাপুঞ্জকে রক্ষা তো করেই না, বরং রাজশক্তির অত্যাচার এবং নিগ্রহে প্রজাপুঞ্জের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। বহিরাগত যবন জাতি বিভিন্ন স্থানে এখন কেন্দ্র স্থাপন করেছে–সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা প্রতিদিন তাদের দুঃখের কথা নিবেদন করছে ঐ সকল কেন্দ্রে। আর প্রতিদিনই তারা অগ্রসর হয়ে আসছে। তুমি শুনলে অবাক হবে যে তোমাদের এই অঞ্চল থেকেও একজন ভিক্ষু ঐরূপ একটি তুর্কি কেন্দ্রে গিয়েছে।