কপর্দকহীন অবস্থায় সে বনভূমিও অতিক্রম করে। দেখে যে রাত্রিকালই বরং ভ্রমণের জন্য অধিকতর নিরাপদ। ব্যাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু বরাহ ভল্লুক ইত্যাদির সঙ্গে কয়েকবারই তার সাক্ষাৎ লাভ ঘটেছে। দেখেছে, মানুষের চাইতে পশু সত্যিই কম বিপজ্জনক।
যে বর্ধিষ্ণু গ্রামটিতে প্রথম এবং সাদর আপ্যায়ন পায় তার নাম কুসুম্বী। সেখানে সে কয়েকদিন অবস্থান করে। গৃহস্থ ছিলেন কুম্ভকার–সুতরাং দরিদ্র হলেও কর্মের বিনিময়ে তারা তাকে উত্তম আশ্রয় দেয়।
সে তখন অনন্যোপায়। তাকে কিছু উপার্জন করতে হবে। তারপর তাকে আবার গৃহে প্রত্যাগমনের চেষ্টা করতে হবে। তার এখন মনে হয়, গুরু বসুদেব সম্ভবত এই সকল পরিস্থিতির জন্য শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। তার হাসি পায় নিজের অবস্থা দেখে। আসলেই সে মূর্খ। যে শক্তি সমগ্র সংসারে বিস্তৃত, সেই শক্তির প্রতিকূলে সে যেতে চেয়েছে কোন সাহসে? তার শক্তি কোথায় যে সুধীমিত্রের মতো সামন্তপতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে? ধর্ম আছে, শাস্ত্র আছে, সংস্কার আছে–সে নিজ ইচ্ছায় চলতে চাইলেই হলো? নীচ দস্যুর কাছে যে কৃপার পাত্র–তার আবার শিল্পী হবার সাধ?
কুসুম্বীতে অধিকাংশই ক্ষেত্ৰকর। এখানে ভূমি প্রায়শঃ সমতল এবং নদীতীরবর্তী বলে বৎসরের অধিকাংশ সময় থাকে আর্দ্র ও উর্বরা। গৃহস্থরা ধনশালী না হলেও প্রায় সকলেই সম্পন্ন। সুতরাং শ্যামাঙ্গকে অবাঞ্ছিত জ্ঞান করে না কেউ। তদুপরি সে কর্মবিমুখ নয়–কুম্ভকারের কাজগুলি সে যত্নসহকারেই নিষ্পন্ন করে। মনোহরদাস বৃদ্ধ হয়েছেন, সকল কাজ তাকে দিয়ে হয় না। ওদিকে আবার তার পুত্রটি রত্নবিশেষ। বুদ্ধিতে বাতুলপ্রায়–এবং শ্রমকাতর। অথচ এই সময়ই কুম্ভকারদের উপার্জনের কাল, দূরে–অদূরে মেলা হচ্ছে, তৈজসাদি যতো অধিক নির্মিত হবে ততোই উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। মনোহরদাস চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। এমন সময় শ্যামাঙ্গকে পেয়েছেন তিনি। তাঁর আশা, শ্যামাঙ্গ যদি তার কাছে থাকে, তাহলে এ বৎসর ভালো উপার্জন করবেন। তাই তিনি শ্যামাঙ্গকে স্নেহ প্রদর্শন করতে কখনও কার্পণ্য বোধ করেন না। কিন্তু শ্যামাঙ্গের আচরণ লক্ষ্য করে মনে তার শঙ্কা জাগে। মনে হয় তরুণটি অত্যধিক রহস্যময়। একেকদিন দিগন্ত পানে এমন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে যে ডাকলেও উত্তর পাওয়া যায় না। কিংবা বালখিল্য পুত্তলি নির্মাণের সময় এমন অভিনিবেশসহকারে সে কাজ করে, যে না দেখলে বিশ্বাস হবার কথা নয়। মনোহরদাস অবাক হন, একটিমাত্র পুত্তলি গঠনেই সে দণ্ডাধিককাল ব্যয় করে। তবে হ্যাঁ–যা করে সে, তার তুলনা হয় না। মৎস্য হোক, গোয়ালিনী হোক, মৃৎশকট হোক, পক্ষী হোক–বড় সুন্দর পুত্তলিগুলি।
শ্যামাঙ্গ যেদিন কর্ম থেকে অবকাশ প্রার্থনা করলো সেদিন মনোহরদাস বিলক্ষণ উদ্বিগ্ন হলেন। বারবার জানতে চাইলেন–বৎস, আমরা জানি তোমাকে স্বদেশে প্রত্যাগমন করতে হবে–কিন্তু তবু এখানে কি তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে, বলো?
না না, এ আপনি কি বলছেন, শ্যামাঙ্গ বৃদ্ধকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে। বলে, আপনার কৃপায় আমার জীবন রক্ষা পেয়েছে, সে কথা কি বিস্মৃত হওয়া সহজ, আপনিই বলুন?
সে বৃদ্ধকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে অন্যকিছু নয়–সে পার্শ্ববর্তী গ্রাম উজুবটে যাবে–সেখানে তার বন্ধু আছে কয়েকজন। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা তার অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। সাক্ষাৎ করেই পুনরায় চলে আসবো, শ্যামাঙ্গ বৃদ্ধকে জানায়। বলে, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমার দ্বারা আপনার কোনোরূপ ক্ষতি আমি হতে দেবো না।
হ্যাঁ, উজুবটেই যাবে সে। দুজন যোগীর সঙ্গে অতি সম্প্রতি তার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন পশ্চিমদেশাগত–সে উজুবট যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। সঙ্গী যোগীটি প্রকৃতই যোগী, সকল ব্যাপারেই তার সীমাহীন অনাসক্তি। সঙ্গীর উজুবট গ্রামে যাবার আগ্রহ দমন করে রেখেছে সে অদ্ভুত কৌশলে। এতকাল বলে এসেছে উজুবট বহুদূর। সে এখন সে কথা বলতে পারে না, কেননা আগন্তক যোগী স্থানীয় ভাষা বিলক্ষণ বুঝতে শিখেছে। সে এখন বলে, উজুবটের গ্রামপতি এবং তার অনুচরেরা ভয়ানক যোগীদ্বেষী, একবার যদি আয়ত্তের মধ্যে পায়, তাহলে আর রক্ষা নেই।
শ্যামাঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় যোগীটি প্রথম বুঝতে পারে যে, তার সঙ্গীটি তার সঙ্গে এতকাল চাতুরী করে এসেছে। সে শ্যামাঙ্গকে ক্রমান্বয়ে অনুরোধ করতে থাকে। জানায়, উজুবটে তার একজন গুরু অবস্থান করছেন–তাঁর কাছে একটি সংবাদ অবশ্যই উপস্থিত করতে হবে–ইতোমধ্যেই অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে তার।
শ্যামাঙ্গের মনেও একটি বাসনা ছিলো। তার বিপদগ্রস্ত অনিশ্চিত অবস্থায় বাসনাটি প্রবল হতে পারেনি–বলা যায়, সুপ্ত অবস্থাতেই বিরাজ করছিলো। কিন্তু যেই তার অবস্থা কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, অমনি সে উজুবট গ্রাম সম্পর্কে সংবাদাদি সংগ্রহ করতে আরম্ভ করে দিলো। ঐ সময়ই সে নিজের মনের একটি দিক আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার ধারণা ছিলো মায়াবতীর মাতাকে দেখবার জন্যই সে উজুবট যাবে। তার মাতৃময়ী মূর্তিটি তার মনে বারবার আসছিলো। এই প্রকার যখন তার মানসিক অবস্থা, ঐ সময়, একদিন মনোহরদাস একটি পুত্তলি তার হাতে এনে দিলেন। জানতে চাইলেন, এইটি কি তোমার গঠন?