বসন্তদাস মলিনমুখ বালকদের কোনোরূপ সান্ত্বনা দিতে পারে না। কারণ বিষয়টি অতিশয় স্পর্শকাতর। সে বহিরাগত, তার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ঘটলেই ব্যাপারটি ভিন্ন আকার ধারণ করবে। সে বালকদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভাসমান নৌকাগুলির দিকে অগ্রসর হলো।
বসন্তদাস বলিষ্ঠ, তায় যুবাপুরুষ। পুনর্ভবা তীরের উচ্চ ভূমিতে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার উন্নতদেহের প্রতিচ্ছায়া নদীবক্ষে এসে পড়েছিলো। পুনর্ভবার স্রোতে জল এখন গৈরিক বর্ণ। উত্তরদেশে সম্ভবত কোথাও বৃষ্টি হয়ে থাকবে–তাই জলের ঐ রূপ। ঐ গৈরিকবর্ণের জল এখন কিছুদিন ক্রমান্বয়ে আসতেই থাকবে।
নদীতীরে একত্রে একটি ক্ষুদ্র নৌবীথি ভাসমান। নৌকাগুলিতে নানান পণ্যসম্ভার। সম্ভবত এরা এখানে রাত্রিযাপন করবে। রাত্রিকালে দস্যুর ভয়, তাই এই ব্যবস্থা। বসন্তদাসের হাসি পায়, মানুষ বড়ই সহজ সরল। পথে দস্যু যা হস্তগত করে সে আর কতটুকু! পক্ষান্তরে যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ গৃহেই অপহৃত হয়ে চলেছে তারা। গ্রামপতি নেয়, রাজপুরুষেরা নেয়, ব্রাহ্মণেরা নেয়, কায়স্থেরা নেয়–কে তাদের শ্রমলব্ধ উপার্জনের অংশ নেয় না? আশ্চর্যের বিষয়, এই চিন্তাটুকু মানুষ করতে চায় না।
সে ঐ সময় শুনলো, নৌকার এক বণিক ডাকছে, মহাশয় কি এই গ্রামবাসী?
কেন? কি প্রয়োজন? বসন্তদাস ঘুরে দাঁড়ায়।
না, জানতে চাইছিলাম। বণিকটি ইতস্তত করে বলে, এই নদীতীর নিরাপদ তো? দস্যুবৃত্তি হয় না তো?
বসন্তদাস হাসে। বলে, আপনি বড় কৌতুকের কথা বললেন, আমি এই গ্রামবাসী আর আমাকেই জিজ্ঞাসা করছেন, আমি দস্যুবৃত্তি করি কি না?
না না, আমি তা বলিনি, লোকটি অতিশয় বিব্রত বোধ করে। আপনারা এখানে নির্ভয়, বসন্তদাস তাদের আশ্বাস দেয়। বলে, এ গ্রামে কোনো দস্যু নেই–তবে আপনারা কি অধিক দূর যাবেন?
না মহাশয়, আমরা নবগ্রাম হাটে যাবো। পথিমধ্যে শুনলাম ওদিকে নাকি রাজার সৈন্যদের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে–কি ঘটনা, এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি কোনো সংবাদ জানেন?
নিকটবর্তী নবগ্রামেও কি কোনো ঘটনা ঘটেছে? বসন্তদাস স্মরণ করার চেষ্টা করে।, এমন কোনো ঘটনার কথা সে শোনেনি। তার একবার মনে হলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি বর্ণনা করে। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তা করে, কি প্রয়োজন অহেতুক নিরীহ লোককে চিন্তাগ্রস্ত করে? সে বলে, আপনারা নির্ভয়ে থাকুন এখানে সকলই নিরাপদ।
নিরাপদ হলেই ভালো, আমরা ক্ষুদ্র ব্যক্তি, সামান্য কিছু উপার্জন করতে পারলেই গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যেতে চাই–আপনি আমাদের নিশ্চিন্ত করলেন, আপনাকে ধন্যবাদ।
লোকটি হয় ভয়াতুর নতুবা বাঁচাল। হয় ভয়, নয় তোষণ। এছাড়া কি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে না? বসন্তদাস বিরক্ত হয় লোকটির অতিমাত্রায় শিষ্ট আচরণ দেখে। তার মনে হয়, এ তো দাসের আচরণ? কতোকাল মানুষ কেবলি দাসত্ব করে যাবে? মনুষ্যজন্মের অর্থই কি দাসত্ব? ভয় আর সন্ত্রাস কি চিরকাল মানুষকে দাস করে রাখবে? এরা কি বারেকের জন্যেও সংঘবদ্ধ হতে পারে না? বোঝে না কি যে সংঘবদ্ধ বাহুবল কি বিপুল ও প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করতে পারে?
বারবার প্রশ্নটি তার মনে আলোড়িত হতে থাকে।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। দূরে বেণুধ্বনি শোনা যায়। বসন্তদাসের নিজ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ হয়। পূর্বদেশের গ্রামগুলিতে সে ভ্রমণ করেছে বন্ধু মিত্রানন্দের সঙ্গে, প্রাচীন পুন্ড্রনগরীতেও সে গিয়েছিলো–সর্বত্রই তার এক অভিজ্ঞতা। রাজশক্তি প্রজাপীড়ন ছাড়া অন্য কাজে কোথাও ব্যবহৃত হয় না। এই রাজশক্তি যে প্রকৃতপক্ষে দুর্বল, এ সত্য কেউ স্বীকার করে না। তারা শুধু মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের হস্তীবাহিনী, অশ্ববাহিনী এবং পদাতিকের সংখ্যাটি দেখতে পায়, আর কিছু দেখতে পায় না।
ঐ সময় সে একটি বালককে দ্রুত ছুটে আসতে দেখলো। বালকটি দ্রুত নিকটে এসে জানালো, আপনি এখানে? ওদিকে আপনার সন্ধান করা হচ্ছে।
কেন? বসন্তদাস অবাক হয়।
সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন প্রহরী এসেছে–তারা আপনাকে সামন্ত গৃহে নিয়ে যেতে চায়।
বসন্তদাস চমকিত হলো। কিন্তু বালকটিকে সে বুঝতে দিলো না। বললো, তুমি গৃহে যাও, আমার সঙ্গে যে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে এ কথাটি প্রকাশ করো না।
অতঃপর বসন্তদাস? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ঘনায়মান অন্ধকার, নদীর ছলোচ্ছল স্রোতধারা এবং নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে কয়েকবার এবং নিজেকে বলে, এইবার তাহলে তোমাকে জীবনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে–তুমি না সংঘর্ষ চাইতে না?
তুমি না হিংসা প্রতিহিংসা উভয়ের নিবৃত্তি চেয়েছিলে? বলেছিলে, যবন জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো অনুচিত–এখন তুমি কী করবে?
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। বসন্তদাস স্থির করলো, আপাতত সে পুনর্ভবার পরপারে আশ্রয় নেবে। না, হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো বাসনা তার নেই। ঐ সময় আকাশের নক্ষত্রমালায় সে প্রিয়তমা পত্নী মায়াবতীর মুখখানি দেখতে চাইলো, কিন্তু দেখলো, শুধু মায়াবতী নয়–আরও একটি মানবীর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে। সে বুঝলো, বালগ্রামের মন্দিরদাসী কৃষ্ণাকে বিস্মৃত হওয়া অতো সহজ নয়।
৯. নবগ্রাম হাট থেকে শ্যামাঙ্গ
নবগ্রাম হাট থেকে শ্যামাঙ্গ ঊর্ধ্বশ্বাসেই পলায়ন করেছিলো। নিশ্চয়ই পলায়ন সেটা। তোমার নিজের অনিচ্ছায়, ভীত হয়ে, লাঞ্ছিত হয়ে, দ্রুত স্থান ত্যাগ করাকে আর কি বলা যায়? নিশ্চয়ই তাকে পলায়ন বলতে হবে। শ্যামাঙ্গ পথ ভুল করে। ঐ সময় তার দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকবার কথা নয় এবং ছিলোও না। সে পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হয়। পথ ছিলো বনভূমির মধ্য দিয়ে। ঐ বনভূমিরই মধ্যে এক পল্লীতে রাত্রিবাস করে সে তার যথাসর্বস্ব হারায়। শুনেছিলো সে যে বনভূমির পল্লীগুলিতে দস্যুদের বাস। তবু ঈশ্বরের কাছে সে কৃতজ্ঞ যে দস্যুরা তার প্রাণ হরণ করেনি। করতে পারতো–সাধারণত করাই নিয়ম–কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, তার ক্ষেত্রে ঐ ব্যতিক্রমটি ঘটেছে।