কী কাজ করো তুমি? মায়াবতী জানতে চায়।
সে কথা এখন নয়, সময় হলে তোমাকে বলবো।
মায়াবতী মরমে মরে যায়। তার দেহসৌষ্ঠব, তার সৌন্দর্য, তার যৌবন–কোনো কিছুই স্বামীকে ধরে রাখতে পারছে না। তার দুচোখে এক অচেনা রহস্য। যখন বাইরে দৃষ্টিপাত করে, তখন মনে হয়, যেন দিগন্ত অতিক্রম করে যাচ্ছে তার দৃষ্টি। যখন ভ্রূকুঞ্চিত করে, তখন মনে হয় না যে ঐ জ্বরেখা আর কখনও সরল হবে।
সে সখী লীলাবতীকে জানায় ব্যাপারটা। বলে, সখী, আমার বড় ভয় করে।
লীলাবতী হাসে। বলে, ভয়ের কিছু নেই, তোর পুরুষ বোধ হয় কোনো কারণে চিন্তাগ্রস্ত–তুই জেনে নে, কী চিন্তা করে ও।
মায়াবতী ঐ রাত্রে স্বামীকে বিশেষ অস্থির দেখলো। বারে বারে সে বাইরে যাচ্ছে। স্বামীর ঐভাব দেখে এক সময় সে স্বামীর দুই পা জড়িয়ে ধরে। বলে, তোমাকে বলতে হবে, তুমি কেন চঞ্চল হয়েছে, কেন তুমি চিন্তাগ্রস্ত আর অস্থির?
বসন্তদাসের বিরক্তি লাগে প্রথমে। তারপর, পদযুগলে স্ত্রীর কোমল বক্ষস্পর্শ, অশ্রুসজল নয়ন এবং বাহু দুটির সজোর আকর্ষণ তাকে কিঞ্চিৎ বিহ্বল করে দেয়। স্ত্রীকে সে দুহাতে তুলে এনে শয্যায় বসায়। তারপর তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বলে, মায়া, তুমি আমার গোপন কথা জানতে চাও–কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমার গোপন কোনো কথা নেই। পিপ্পলী হাটে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বাধা দেবার চেষ্টা করছি। কীভাবে, সে প্রশ্ন করো না। শুধু আমাকে তুমি বিশ্বাস করো। সম্মুখের কাল বড় ভয়াবহ। আসন্ন ঐ দুর্যোগের কালে অবিশ্বাস ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। বিশ্বাস আর ভালবাসায় আমাদের সংহত এবং দৃঢ় হতে হবে।
মায়াবতীর দেহ শিথিল হয়ে আসে। সে বসন্তদাসের কথা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে। বক্ষের ভেতরে ভয় থর থর করতেই থাকে। তারপর স্বামীর মুখের ঐ দুটি কথা তার মনে মুদ্রিত হয়ে যায়। বিশ্বাস এবং ভালবাসা! আহা কী সুন্দর কথা! মায়াবতীর চিন্তা ক্রমে সহজ হয়ে আসে। বিশ্বাস করি বলেই তো ভালবাসি–আর যদি ভালবাসতে পারলাম, তাহলেই তো আর কোনো ভয় নেই আমার, আমি তখন মুক্ত, নিঃসংকোচ এবং দায়হীন।
বসন্তদাস জানে যে তার আচরণ অনেকের কাছেই বিসদৃশ ঠেকছে। মায়াবতীর মাতুল দীনদাস বুদ্ধিমান লোক। তিনি প্রায় ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন কয়েকদিন। গ্রামের অন্যান্য লোকেদের কৌতূহলের ব্যাপারটাও তার অগোচর নয়। পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি যেভাবে ত্রাস, এবং আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষু দর্শন মাত্র যে তারা অস্থির হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কি! সে জানে, ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সংস্রব কেউই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু তার নিজেরও উপায় নেই।
মিত্রানন্দের লোক বারবার আসছে। প্রত্যেকবারেই তাদের ঐ এক কথা। আর সহ্য হয় না, তোমরা গ্রামবাসীদের জানিয়ে দাও, আমরা যবন জাতিকে ডেকে আনতে চাই। প্রতিবার ওরা আসছে প্রস্তাব নিয়ে, আর প্রতিবারই বসন্তদাস তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, এখনও সময় হয়নি, মিত্রানন্দকে বলো, সময় হলে আমিই সংবাদ দেবো।
মিত্রানন্দের লোকেদের সঙ্গে তাকে দীর্ঘ আলাপে বসতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে, যবন জাতি বহিরাগত–তারা এলে তুমি আমি কেউ থাকবো না। আর জেনো, তারা শুধু রাজ্য জয়ই করছে না–ধর্মকে পর্যন্ত জয় করে নিচ্ছে। এ বড় চিন্তার কথা–এমতাবস্থায় আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমরা কী করবো। এক সন্ত্রাসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য যদি আমরা আরেক সন্ত্রাসের মধ্যে নিপতিত হই, তাহলে সেটা কোনো কাজের কথা নয়।
বসন্তদাসের কথায় ভিক্ষুরা নীরব থাকে। শুধু অপলক চক্ষুর স্থির দৃষ্টি মেলে রাখে বসন্তদাসের মুখের উপর। বসন্ত অনুমান করে তার যুক্তি শ্রোতারা গ্রহণ করছে না–কিন্তু তবু সে হতোদ্যম হয় না। যতোদিন পারে, ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিলম্বিত করতেই হবে। এ বিষয়ে সে আশাবাদী। কারণ মিত্ৰানন্দ তার সুহৃদ বন্ধু এবং সে বসন্তকে বিশ্বাস করে।
প্রতিদিন অপরাহ্নে সে নদীতটে ভ্রমণ করে। কখন যে ভিক্ষুরা আসবে তার স্থিরতা নেই। তাই তাকে নদীতটে আসতে হয়। তার চপল স্বভাব এখনও আছে। বালক ও কিশোরদের সঙ্গে সে একেকদিন ক্রীড়ায় মত্ত হয়। দণ্ডগুলি ক্রীড়ায় তার পারদর্শিতার কথা ইতোমধ্যে গ্রামের কিশোর ও বালকদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেছে। সুতরাং সে নদীতটে এলে বালকদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়।
আজ সে নদীতটে এসে দেখলো বালকেরা বিমর্ষ মুখে বসে আছে। কি সংবাদ? সে সন্ধান নিয়ে জানলো যে দ্বিপ্রহরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাটি সামান্য, কিন্তু মানুষের অনুদারতা এবং ক্রোধ সামান্য ঘটনাকেই প্রকাণ্ড করে তুলতে পারে।
ঘটনাটি হাস্যকরও কিঞ্চিৎ। দ্বিপ্রহরে অভিরাম উপাধ্যায় স্নানে এসেছিলেন। তাঁর অবয়ব শীর্ণাকার, এবং মস্তকে একটি সুন্দর ইলুপ্তি বিরাজমান। তাঁর তৈলসিক্ত ইলুপ্তিটি কখনও কখনও দর্পণের কাজ করে। তিনি যখন নদীজলে নেমে প্রথম ডুবটি দিয়ে সূর্যস্তব আরম্ভ করেছেন, শ্লোকের প্রথম চরণটি উচ্চারিত হয়েছে–কি–হয়নি–ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং পর্যন্ত বলেছেন মাত্র, ঐ মুহূর্তে বালকদের দণ্ডপ্রহৃত গুলিটি তীরবেগে ছুটে এসে তাঁর। মস্তকের ইন্দ্রলুপ্তিটিতে আঘাত করে। আঘাতটি তীব্র হওয়ায় ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং রক্তপাত হয়। উপাধ্যায় মহাশয় কুপিত হন, উপবীত হস্তে ধারণ করে বালকটি এবং তার চতুর্দশ। পুরুষকে অভিসম্পাত করেন। তাতেও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয় না, বালকটিকে তিনি ধরে নিয়ে যান নিজ গৃহে। সেখানে তাকে যথেচ্ছ প্রহার করা হয়। ঘটনার সেখানেই সমাপ্তি হয়নি, শোনা যাচ্ছে, বালকটির পিতাকে ব্রাহ্মণরক্তপাতের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।