এই যদি তোমার আচরণ হবে, তাহলে কি কারণে এই কবরী–বন্ধন, বলো? কেন এই কুরুবক আর শিরিষ, কেন এই পট্টবস্ত্র? কি প্রয়োজনে কণ্ঠে এই স্বর্ণমালা, সুদৃশ্য এই কথুলিই বা কেন? কুঙ্কুম চন্দন এবং অলক্তক কোন কাজে লাগবে, বলো?
অতিশয় নীচ! মায়াবতী তখন মনে মনে বলছে, অতিশয় নীচ এই ব্যক্তি যে প্রণয় সম্ভাষণকালেও কলহ করতে চায়।
স্ত্রীকে নিরুত্তর দেখে বসন্তদাস তাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে। বলে, জানো আমি কি করবো এই কবরীবন্ধনের?
ছি ছি–এ কি নারী পীড়ক! একেবারে অকৃত্রিম দস্যু হয়ে এসেছে পূর্বদেশে বাণিজ্য করে সে বারেক ভাবে, বাহুপাশ ছিন্ন করে ছুটে পলায়ন করে।
জানো, এই কুঙ্কুম চন্দনের কি হবে?
মা গো! এ বড়ই দুঃশীল–এই নাগরস্বভাব কিভাবে হলো এর–এ তো এমন ছিলো। তবে কি অন্য কোনো ব্যক্তির বাহুপাশে আবদ্ধা সে? মায়াবতী এবার প্রাণপণে দেহ সঞ্চালিত করে, যদি পাশমুক্ত হওয়া যায়।
আর এই সুদৃশ্য কণ্ডুলিটির কি দশা হবে, ভেবেছো একবার?
মরণ দশা! ছি ছি, এমন ওষ্ঠকর্তিতও হয় মানুষ! সে কুঞ্চিত করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে স্বামীর দিকে।
বসন্তদাসের কিন্তু বিকার নেই। সে তখনও হাসছে। বললো, কুপিতা রমণী কিন্তু অধিকতর রমণীয়া–সে কথা জানো তো? কথাটি বলে সে তাম্বুল পাত্র থেকে দুটি গ্রন্থিবদ্ধ তাম্বুল একত্রে হাতে নিয়ে বললো, শ্বশুরালয়ে আসব পানের ব্যবস্থা থাকে না কেন বলতে পারো? অতো মধুক বৃক্ষ দিয়ে তোমরা কি করো?
এবার আর সহ্য হলো না। মায়াবতী ঈষদুচ্চকণ্ঠে শ্লেষ ঢেলে উত্তর করলো, আসব পানের যদি এতোই আগ্রহ, তাহলে নটিগৃহে গেলেই হতো, এখানে আগমনের তো প্রয়োজন ছিলো না।
বসন্তদাস তখনও হাসে। ততক্ষণে সে তাম্বুল চর্বণ করেছে এবং চর্বণজনিত কারণে স্বেদাক্ত হতে আরম্ভ করেছে। ঐ অবস্থাতেই সে বলে, হ্যাঁ, সে স্থানে গেলেও হতো, কিন্তু সেখানে কি মায়াবতী পাওয়া যায়, এমন মায়াবতী কি আর কোথাও আছে, বলো?
অতঃপর বসন্তদাস যা আরম্ভ করলো সে বর্ণনা বাৎসায়ন বিস্তৃত এবং অনুপুঙ্খ দিয়েছেন। তার পুনর্বৰ্ণনা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
০৮. মৃগনাভিচূর্ণ রাগোত্তেজনা
মৃগনাভিচূর্ণ রাগোত্তেজনা প্রগাঢ়তর করতে পারে এবং শোনা যায়, ক্ষেত্র বিশেষে রাগমোচন বিলম্বিতও করে থাকে। কিন্তু তারও শেষ আছে। এক সময় ক্লান্ত দুই শরীরের স্বেদে শয্যা যখন সিক্তপ্রায়, তখন মায়াবতীর শরীরে যেন তার সমস্ত বিরহকালের ঘুম এসে নামলো, তারপর আর কিছু সে জানে না।
রাত্রির শেষ যামে যখন জাগলো, তখন দেখে, দ্বার অর্গলমুক্ত এবং বসন্তদাস শয্যায় নেই। বাইরে তখনও ঘোর অন্ধকার। বন্য কুক্কুট সবে দুটি একটি ডাকছে। প্রথমে মনে হলো, শারীরিক প্রয়োজনে হয়তো বসন্তদাসকে বাইরে যেতে হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও যখন সে এলো না, তখন মায়াবতীর চিন্তা হতে লাগলো, মানুষটা গেলো কোথায়? জননীকে ডাকবে কিনা এ চিন্তায় যখন সে দ্বিধান্বিতা, তখনই দেখলো, সন্তর্পণে বসন্তদাস কক্ষে প্রবেশ করছে।
কোথায় যাওয়া হয়েছিলো? সে জিজ্ঞাসা করে।
ঐ প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়াবতাঁকে দেখে বসন্তদাস। তারপর বলে, বাইরে।
স্বামীর ঐ সংক্ষিপ্ত উত্তর মায়াবতাঁকে বিমূঢ় করে দেয়। শুধু উত্তরের সংক্ষিপ্ততাই নয়। দেখে স্বামীর মুখে বিচিত্র গম্ভীর একটি ভাব–যা পূর্বে সে কখনও দেখেনি। দীপে তখনও তৈল ছিলো। সে স্বামীর মুখপানে বারবার দৃষ্টিপাত করছিলো। রাত্রিকালের আলিঙ্গনাবদ্ধ স্বামী রাত্রি বিগত হলেই কেমন করে অচেনা হয়ে যায় সে ভেবে পাচ্ছিলো না। শুধু একটি কথা ঐ মুহূর্তে তার স্মরণ হলো। কথাটি বিবাহ রাত্রে মালিনী আয়ী বলেছিলো। বলেছিলো, দেখিস লো, পুরুষ বড় চঞ্চলমতি হয়–অঞ্চলে বেঁধে রাখিস, যেন পলায়ন না করতে পারে।
স্বামীর একেকদিনের ঐ প্রকার রহস্যময় অন্তর্ধান এবং আবির্ভাব তাকে স্বস্তিবিহীন করে তুললো। একদা যখন রাত্রির প্রথম যামেই বসন্তদাস চলে গেলো এবং সারা রাত্রি ফিরলো না–তখন মায়াবতী ভেঙে একেবারে লুটিয়ে পড়লো। সমস্ত রাত্রি সে কাঁদলো। কিন্তু তখনও সে বাইরে কারও কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করেনি। সারারাতের রোদনে তার মুখে মলিন প্রচ্ছায়া দেখা দিয়েছিলো। জননী উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলে সে সত্য গোপন করে বললো, শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে মা, অন্য কিছু নয়। এবং ঐ সময়ই পিতা শুকদেব একদা জানালেন, বৎসে, জামাতাকে বলল সে যেন ভিক্ষু ও যোগীদের সান্নিধ্য পরিহার করে। এমনিতে তো কায়স্থ পল্লীর লোকেরা আমার প্রতি বিরূপ এবং বিদ্বষ্ট। এখন ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যের কথা যদি কেউ সামন্তপতির গোচরে আনে, তাহলে আমাদের সবাইকে বিপদে পড়তে হবে।
মায়াবতী সেদিন শয্যায় দুবাহু দিয়ে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে রাখলো। মুহূর্তের জন্য নিদ্রা গেলো না এবং বাহুবন্ধনও শিথিল করলো না। বসন্তদাস নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে সে বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় করলো। বললো, আমি তোমাকে যেতে দেবো না। মধ্যরাতে তুমি কোথায় যাও? ভয়ে আমার প্রাণ কাঁপে–পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির কথা তুমি জানো–তবু
বসন্তদাস যুবতী পত্নীর শরীরে সস্নেহ হাত বুলায়। বলে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। মায়াবতী, আমি কোনো পাপকর্মে লিপ্ত নই–তোমার পিতা আর মাতুলকে বলল, আমি যা করছি, সকলের মঙ্গলের জন্যই করছি।