দিন দুই পরে যখন সন্ধ্যাকালে দেখলেন বসন্তদাস নদীতীরে কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে গভীর আলাপে মগ্ন তখন আর নীরব থাকতে পারলেন না। ঘটনাটি শুকদেবের গোচরে আনলেন। শুকদেব শুনলেন। শুনে মৃদু হাসলেন, কিছু বললেন না। দীনদাস ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আপনি ব্যাপারটি সহজ বলে মনে করছেন কিন্তু আমার সন্দেহ, ব্যাপারটি সহজ নয়। জামাতা যদি বিপদে পড়ে, তাহলে কী হবে চিন্তা করেছেন?
শুকদেব তখন শ্যালকের মুখপানে দৃষ্টি রেখে একটি ক্ষুদ্র শ্বাস মোচন করে বলেন, আমি ভবিতব্য মানি দীনদাস–যদি ভাগ্যে তোমার অশুভ কিছু লিপিবদ্ধ থাকে, তাহলে কি তুমি তা পরিহার করতে পারবে? পারবে না, সুতরাং দুশ্চিন্তা করে কি হবে! রাজার পাপে রাজ্য নাশ–এ প্রবাদটি তো জানো। রাজার পাপ রাজা একাকী বহন করেন না–তার পাপ প্রজাপুঞ্জেও বর্তায়। যদি ঐ পাপের দায় তোমার বিধিলিপি হয়ে থাকে, তাহলে কি তুমি তা খণ্ডন করতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবে না। আমাদের জামাতাটি তো আর বালক নয়–মঙ্গলামঙ্গল জ্ঞান তার নিশ্চয়ই হয়েছে। তুমি অথবা আমি কিছু বললেও সে শুনবে না।
না ভ্রাতঃ, এভাবে নির্বিকার থাকা সমীচীন নয়–দীনদাস তাঁর উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। বলেন, জলধর দত্ত এবং কায়স্থ পল্লীর লোকেরা যেখানে আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সেখানে আপনার নিস্পৃহ এবং নীরব থাকা উচিত নয়। জামাতাকে বলবেন, যেন সে। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও যোগীদের সঙ্গ পরিহার করে।
উত্তম, বলবো, শুকদেব পুনরায় একটি শ্বাস মোচন করে জানালেন।
০৭. প্রথম রাত্রে মায়াবতীর লজ্জা
প্রথম রাত্রে মায়াবতীর লজ্জা হচ্ছিলো।
বিবাহের পর মাসাধিককাল তার স্বামীগৃহে অতিবাহিত করেছে। স্বামীসঙ্গে প্রথম কদিন তার ভয় হতো–বিশেষত দেহ মিলনের ব্যাপারটা তাকে রীতিমতো পীড়িত করতো। পুরুষ মানুষ যে ঐ একটি বিষয় বই অন্য কিছু চায় না, এটা বুঝতে পেরে সে তখন মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু অল্প কদিন পরই সে অনুভব করে যে স্বামী তার কাছে আরও কিছু চায়। কিন্তু সেটা যে কি বস্তু তা সে বুঝে উঠতে পারে না, ঐ সময় সে কখনই পারেনি। তারপর বসন্তদাস হঠাৎ বাণিজ্য যাত্রা করে। শুরু হয় তার বিরহযাপন। স্বামীসঙ্গহীনা না হলে স্বামী যে কি বস্তু তা কোনো নারীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে নিজেও প্রথমদিকে বোঝেনি। বুঝলো গত সাত/আট মাসে। সাত/আট মাস পর আবার তার স্বামীসঙ্গ।
তবু প্রথমদিন তার লজ্জা কাটছিলো না। শুধু লজ্জা নয়, সেই সঙ্গে সে আবার প্রবল আকর্ষণও অনুভব করছিলো। তদুপরি ছিলো একটি দুর্বহ কষ্ট, প্রণয়ভারের কষ্ট।
সুতরাং ঐ প্রকার নানাভাবে মিশ্রিত বিচিত্র একটি মানসিক অবস্থা নিয়ে সে শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলো।
প্রকোষ্ঠে ধূপ জ্বলছিলো–দীপাধারে প্রদীপ শিখাঁটি ছিলো উজ্জ্বল–শয্যা কোমল এবং দুগ্ধফেননিভ। উপাধান স্কীদের–তাতে আবার সুচারু সূচিকর্ম–একটি লতিকা, দুটি পত্র, একটি কলিকা–এইরূপ চিত্রণ। ওদিকে বক্ষের কঙুলি স্বেদসিক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। একেকবার মনে হচ্ছিলো, গবাক্ষ উন্মুক্ত করে।
কিন্তু রাত্রি তখনও গম্ভীর হয়নি একথা স্মরণ হওয়ায় তাকে বিরত থাকতে হয়েছে। সে জানে, কৌতূহলী রমণীরা বাইরে অপেক্ষা করে আছে। গবাক্ষ অর্গলমুক্ত করলেই তারা একত্রে হেসে উঠবে।
ঐভাবে স্বেদাপ্লুত হতে থাকলে কুঙ্কুমবিন্দু এবং চন্দনতিলকের কি দশা দাঁড়াবে ভেবে তার কান্না পাচ্ছিলো। কেন যে দহ্মাননা লীলাবতী তাকে এমন করে সাজিয়ে দিলো? তাম্বুল রাগে ওষ্ঠ রঞ্জিত করবার জন্য তাকে দুতিনবার তাম্বুল চর্বণ করতে হয়েছে। শেষ তাম্বুলটিতে আবার মৃগনাভিচূর্ণ প্রযুক্ত ছিলো। সে বুঝছিলো, অতিমাত্রায় স্বেদাক্ত হওয়ার কারণ ঐটিই। বারেক সে মনে মনে প্রগল্ভা হচ্ছিলো, বারেক আবার লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিলো।
তার মনে হচ্ছিলো, প্রকোষ্ঠের বাইরে যায়। কেননা এমন রীতির কথা তো সে কখনও শোনেনি। পিতৃগৃহে কন্যা শয়নগৃহে অপেক্ষা করবে স্বামীর জন্য, এমন কি হয়? লোকটা মায়াবতাঁকে জানিয়ে গেলো, আমি এখনই আসছি–কিন্তু তার সেই এখন কি এতোক্ষণেও হয়নি?
বসন্তদাস শয়নগৃহে বেশ বিলম্বে আসে। কক্ষে প্রবেশ করেই স্ত্রীকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও তার পশ্চাতে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কৌতুকে ঈষৎ হাসে। তারপর মায়াবতীর স্কন্ধদেশ স্পর্শ করে ডাকে, হলুদ পক্ষিটি আমার!
মায়াবতী অপ্রস্তুত, এ কী সম্ভাষণ–ছি! পূর্বদেশ অঞ্চল থেকে কি এই আচরণ শিক্ষা করে এসেছে? ক্ষণকাল পরে কানের কাছে উষ্ণ শ্বাস পড়ে এবং শোনে, হলা পিয় সহি!
মায়াবতী ওষ্ঠ দংশন করে, না, এই নির্বোধের সম্ভাষণে সে সাড়া দেবে না।
কিন্তু নির্বোধ নিরস্ত হয় না। সে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে চায়। তখন তার অক্ষিপক্ষ্ম আপনা থেকেই নির্মীলিত হয়ে এসেছে–আর ঐ মুহূর্তটিতে বসন্তদাস গভীর স্বরে ডাকে, মায়া, আমার মায়াময়ী!
ঐ ডাকে মায়াবতীর অন্তরাত্মা আমূল কম্পিত হয়। শরীরের ভার যেন পদযুগল আর ধারণ করতে পারে না। তার চক্ষুরুন্মীলন হয়, কিন্তু দৃষ্টি বিনতই থেকে যায়।
আমার মুখপানে চাও মায়াবতী!
প্রণয়ীর প্রার্থনা যেন। অনুশীলনসিদ্ধ একেবারে কুশলী প্রণয়ী! না জানি কতত রমণীর মানভঞ্জনে এই একই বাক্য প্রয়োগ করে এসেছে। মায়াবতী মনের ভেতরে কোথায় যেন ক্ষীণ একটি কণ্টক দংশন অনুভব করে। স্বেদ তখন আর বিন্দুতে থেমে নেই, একেবারে স্রোতধারা হয়ে নেমে আসছে। সে পুনরায় মুখ নত করে।