ঐ সময় সভামঞ্চ থেকে দুজন ঘাতক নেমে আসে, কিন্তু শুদ্ধানন্দকে আর নাগালে পাওয়া যায় না।
শুদ্ধানন্দকে দুটি শস্ত্রধারী তরুণ টানতে টানতে পথে এনে দাঁড় করায়। তারপর বলে, এ পথে আর কখনও আসবেন না–এবার যান, পলায়ন করুন।
ঘটনাটির সমাপ্তি কেন ঐভাবে হয়েছিলো সে রহস্য ব্যাখ্যা করা দুষ্কর। সম্ভবত তার প্রয়োজন ছিলো না। যাদের প্রয়োজন ছিলো, তারা পূর্বে অথবা পরে ঐ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রহস্যটি কি? না সমবেত জনতা এবং দলপতির ইচ্ছার পার্থক্য। দলপতি যা চায়, জনতা তা চায় না। সেনাপতি যা চায়, সৈন্যদল। তা চায় না, গ্রামপতি যা চায়, গ্রামবাসী তা চায় না–ব্যাপারটি এইমত। এবং ঐ কারণেই ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের প্রাণ রক্ষা পায়।
তবে প্রাণরক্ষা পাওয়ার ঘটনাটি প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি। প্রাণনাশের ঘটনাটিই প্রধান হয়ে উঠেছিলো। এবং সেও হয়েছিলো সামন্ত হরিসেনের পরিকল্পনা মতোই। তিনিও চেয়েছিলেন, এমন শাস্তি দেবেন ব্রাত্য চণ্ডাল–ডোমদের, যেন তারা কোনোদিন। সামন্ত প্রভুর বিরোধিতা করার কথা স্বপ্নেও চিন্তা না করতে পারে।
বলা কঠিন, শুদ্ধানন্দ ঘটনাটির কী বর্ণনা দিয়েছিলেন, কিংবা আদৌ কোনো বর্ণনা দিয়েছিলেন কিনা। কিন্তু লোকমুখে ঘটনাটির নানা প্রকার বর্ণনা প্রচারিত হতে আরম্ভ করে। এবং ঐ সকল বর্ণনায় ত্রাস, উল্লাস, হতাশা, বিভীষিকা, সমবেদনা ইত্যাদি নানা প্রকার মানবিক প্রতিক্রিয়া মিশ্রিত হয়ে যায়। গ্রামপতি সামন্তপতি, এবং হরিসেনের অনুচরবর্গ ব্যাপারটির যথার্থ নিষ্পত্তি হয়েছে মনে করলেও সাধারণ গ্রামবাসী যারা, ক্ষেত্রকর, কুম্ভকার, কর্মকার, তন্তুবায়, অর্থাৎ প্রাকৃতজন, তাদের মনে স্বস্তির সঞ্চার হয় না। প্রত্যেকেই আশঙ্কা করতে থাকে–এই বুঝি ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। রাজপুরুষ দর্শনমাত্র তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলো। অবস্থা এমন হলো যে, ভিক্ষু যোগীদের সঙ্গে তারা বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ রাখে। ডোম–চণ্ডালদের তারা গৃহকাজে আর ডাকে না। দিবারাত্র সন্ত্রাস, অস্বস্তি এবং দুশ্চিন্তা পিপ্পলী হাটের নিকটবর্তী গ্রামগুলিকে করে রাখলো। নীরব, নিষ্ক্রিয় এবং অন্ধকার।
উজুবট দূরের গ্রাম। কিন্তু পিপ্পলী হাটের ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনাটির বিবরণ এই গ্রামেও এসে পৌঁছেছিলো। ব্রাহ্মণ সোমজিৎ উপাধ্যায় যদিও বোঝাচ্ছিলেন যে কাহিনীটি অলীক, যা শোনা গেছে তা দুষ্টজনের প্রচার মাত্র, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তার ক্ষেত্রকর ভূমি কর্ষণে যায় না, গাভীগুলির যত্ন করে না রক্ষপাল কিলোর দুটি, গৃহদাসী বালিকা দুটি সেই যে গিয়েছে, আগমনের কোনো লক্ষণ নেই।
সোমজিৎকে অগত্যা আসতে হলো ক্ষেত্রকর পল্লীতে, শুকদেবের কাছে। বললেন, তোমরা অকারণ ভীত হয়েছে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি অলীক–হরিসেন কিঞ্চিৎ উগ্র হলেও তিনি প্রাণনাশের কাজ কদাপি করবেন না।
কিন্তু গ্রামের লোক উপাধ্যায় মহাশয়কে বলে, প্রভু, হরিসেনকে বলুন, তিনি যেন আমাদের উপর নিপীড়ন না করেন।
সোমজিৎ ঐ প্রার্থনা শ্রবণ করেন শুধু। করণীয় কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। তিনি বোঝেন, তার কথা কেউ শুনবে না, তবু তিনি চেষ্টা ত্যাগ করলেন না।
হরিসেনের কাছে গেলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে উপাধ্যায় মহাশয়ের পরামর্শ শুনলে তাঁকে সমূহ ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। বললেন, ওদের অনাহারে রাখুন, দেখবেন, ওরা বিনয়ী এবং শ্রমশীল দুই–ই হয়েছে, সুতরাং ওদের অনাহারে রাখুন।
কিন্তু ওরাও তো মানুষ!
হরিসেন হা হা স্বরে হেসে ওঠেন। বলেন, উপাধ্যায় মহাশয়, আপনি ওসব বুঝবেন না।
ওরা যদি কর্ম সম্পাদন না করতে চায়, তাহলে উপায় কি হবে, চিন্তা করেছেন? সোমজিৎ প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ, করেছি, কিছুই হবে না, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না–এক সময় বাধ্য হয়ে ওরা আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু ওদের যদি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে? ওরাও তো মানুষ!
পুনরায় উচ্চরোলে হাস্য করেন সামন্ত হরিসেন। বলেন, কী যে বলেন উপাধ্যায় মহাশয়–ওরা মানুষ হলেও আপনার আমার মতো নয়। ভগবান ওদের জন্য কর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভাগবতের কর্মযোগ ও কর্মফলের ব্যাপারটি তো আপনি ভালো জানেন। এই মানবজন্মে ওরা শূদ্র–ঐ কাজ করার মধ্যেই ওদের মানবজন্মের সার্থকতা। কাজ না করা ওদের জন্য বিপথগামিতা এবং ধর্মবিরুদ্ধ–আপনি তা সমর্থন করবেন?
সোমজিৎ উপাধ্যায় হরিসেনের গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তাঁর আশঙ্কা হতে লাগলো একটি অশুভ পরিণাম ঘনিয়ে আসছে। রাজপুরুষেরা কিছু করছে কিনা তিনি জানেন না, সামন্তপতি ও গ্রামপতিরা একেবারেই উদাসীন। কর্মজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারলে যে সকলেরই সমূহ ক্ষতি সেটা কেউই বুঝতে চাইছে না। এই প্রকার অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে সামাজিক উপপ্লব অবশ্যম্ভাবী–মাৎস্যন্যায় কেউ রোধ করতে পারবে না। তিনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অসহায় বোধ করতে লাগলেন।
বসন্তদাসের আগমন হয় পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির অব্যবহিত পরে। জামাতার আগমনে শুকদেবের পারিবারিক জীবন আনন্দে উৎফুল্ল হলো বটে কিন্তু তার মনের নিগূঢ়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিলো, তা কাটলো না–বরং প্রবলতর হলো। বিশেষত দীনদাস, মায়াবতীর মাতুল, বসন্তদাসের মুখভাব ফিরে ফিরে লক্ষ্য করতে লাগলেন। একটি দুশ্চিন্তা তার মনে শলাকার মতো বিদ্ধ হয়ে রইলো। সেটি হলো, জামাতা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যাপারটি সম্পর্কে একটি বাক্যও কখনও উচ্চারণ করছে না। তিনি বুঝতে পারেন না, তবে কি বসন্তদাস কোন গূঢ়কর্মের সঙ্গে যুক্ত? আর তাই সে জানতে দিতে চায় না বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার কি প্রকার সম্পর্ক হয়েছে?