অতঃপর যা ঘটতে থাকে তার বর্ণনা দেওয়া মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। ভয়ানক উত্তেজিত এবং উৎক্ষিপ্ত মানুষ মার মার ধর ধর রব করতে থাকে। অচিরাৎ বজ্রসেনের দেহ ডোমনীরা ছিন্নভিন্ন করে দেয়–কেননা ধারালো অস্ত্র তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিলো–ঐ অস্ত্রই তাদের পণ্য উৎপাদনের প্রধান অবলম্বন। বজ্রসেনের সহচরদ্বয় পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না–সমবেত জনতার মুষ্টি, পদ এবং কর্মকারদের হস্তলীর আঘাতে দুজনেরই দেহ কিমাকার মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
পিপ্পলী হাটে সংঘটিত ঐ ঘটনার সময় হরিসেন গৃহে ছিলেন না। বয়স্য ও সুহৃদ দুই গ্রামপতিকে সঙ্গে নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। মৃগয়াক্ষেত্রেই তিনি সংবাদটি পান। তারপর আর বিলম্ব করেননি, যথাসম্ভব দ্রুত প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে গ্রামপতি ও সামন্তদের যাকে পেয়েছেন তাকেই সঙ্গে নিয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো দেববারে–তিনি পিপ্পলী হাটে তার বাহিনী নিয়ে উপনীত হলেন বুধবারে। দুদিন বিলম্ব হয় তাঁর লোক সংগ্রহের কারণে। প্রায় দ্বিশতাধিক শস্ত্রধারী যোদ্ধার দল যখন হাটে উপস্থিত হলো তখন নিকটের গ্রামগুলি হয়ে গেলো জনশূন্য!
হরিসেন প্রথমেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্ধান করেন। ভিক্ষু চেতনানন্দ তখন মৃতপ্রায় সহচর শুদ্ধানন্দ তাঁর শুশ্রূষা করছেন। অন্য ভিক্ষুরা কোথায়, কেউ জানে না। যুবক ডোমেরা পূর্বেই গভীর বনভূমিতে পলায়ন করেছে। ডোম পল্লীতে কেবল বৃদ্ধ, শিশু এবং রমণী। কিন্তু হরিসেন তখন দারুণ ক্রোধে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি যা। করলেন, তার তুলনা হয় না। সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে ঐ কাজের কল্পনা করাও অসম্ভব।
কুসুম ডোমনীকে ধরে এনে সর্বসমক্ষে দাঁড় করানো হলো এবং ঘোষণা করা হলো এই স্বৈরিণী সকল বিরোধের মূল, দেহের যে অংশের কারণে এই স্বৈরিণী পুরুষ সমাজে বিরোধ এবং লোভের বীজ বপন করে, শরীরের যে অংশ যথার্থই নরকের দ্বার, সেই অংশটি আমরা প্রজ্বলিত করে দেবো।
ঘোষণাটি সামন্ত হরিসেনের। ঘোষক কেবল বাক্যগুলি সচিৎকার উচ্চারণ করে গেলো। এবং তারপর সর্বসমক্ষে কুসুমকে নির্বস্ত্রা করে তার যোনিদেশে একটি উত্তপ্ত লৌহদণ্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। মৃত্যুর পূর্বেকার চিৎকার, বাঁচবার জন্য আকুলি বিকুলি, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ–সবই কুসুম করছিলো। কিন্তু সবই তখন দেখাচ্ছিলো জীবনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন পুত্তলীর হস্তপদ সঞ্চালনের মতো। শস্ত্রধারী সৈনিকদের দৃষ্টি হয়ে উঠেছিলো ভারী নিস্পৃহ। একজন অন্যজনের কানে এমনও মন্তব্য করেছে যে, দেখেছো, স্ত্রীলোকটির দেহে এখনও কিরূপ শক্তি?
ঐ সময় ধূম উদগীরিত হচ্ছিলো প্রবল। বাতাসে ছিলো দগ্ধ মাংস ও ভস্মীভূত কেশের গন্ধ। সূর্য ঐ সময় আবার পূর্বাকাশে একখানি পাটলর্ণের মেঘে তার সিন্দুর বর্ণটি লেপে দেয়। হরিগেনের জয়ধ্বনি দিতে আরম্ভ করে তার পদলেহী অনুচরেরা।
হরিসেন দেখছি প্রকৃতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন!
এ মন্তব্যটি অন্য এক শস্ত্রধারী পুরুষের। ওদিকে নতুন ঘোষণা হচ্ছিলো তখন। কুসুম ডোমনীর গর্ভজাত শিশুপুত্র দুটি জারজ–পাপের সন্তান, অতএব তাদের বিনষ্ট করা হবে।
পরের দৃশ্যটিও সমবেত শস্ত্রধারী সৈনিকেরা অবলোকন করে। প্রায় প্রত্যেকের চক্ষুই রক্তবর্ণ, অত্যধিক মাদক সেবনের কারণেই সম্ভবত পদক্ষেপও অসংবৃত। তারা যা দেখছিলো তা যে মানব সম্পর্কিত কিছু–এই বোধ তখন অনেকেরই ছিলো না।
কিন্তু তথাপি কোথায় কী যেন ঘটে। ঐ জনসমষ্টির মধ্যভাগে, হয়তো গভীর কোনো তলদেশ থেকে, যেখানে দৃষ্টি ঢলে না সেইরূপ কোনো স্থান থেকে কেউ কেউ নয়ন মেলে দেখে দৃশ্যটি। আর খড়গাঘাতে দ্বিখণ্ডিত শিশুর রক্তাক্ত শব, কুণ্ডলীকৃত ধূম, অগ্নির লেলিহান শিখা এবং আকাশের পাটল মেঘে ডগডগে সিন্দুর বর্ণটি, সমস্ত একত্রিত হয়ে অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেন ছিদ্র করে দেয়। আর তাতেই রুদ্ধবাক জনতা যেন অস্পষ্ট ভাষা পায়। একজন আর একজনকে প্রশ্ন করে, কেন? কেন? কেন?
কিন্তু ঐ প্রশ্নের উত্তরদাতা কেউ ছিলো না সেখানে।
ইতোমধ্যে মুমূর্ষ ভিক্ষু চেতনানন্দকে টেনে আনা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ঘোষক জানিয়েছেন–ধর্মবিরোধী অনাচারী এই পামরদের একটিই শাস্তি যা আমাদের পিতৃপুরুষদের কাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। দেখো, তোমরা গ্রামবাসি!
গ্রামবাসীরা তখন দূরে। বনের বৃক্ষান্তরাল থেকে ঐ জনসমাগমটি দেখছিলো কেউ কেউ, কিন্তু প্রকৃত কী ঘটছে, তা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সুতরাং তারা দেখতে পায়নি যে ভিক্ষু চেতনানন্দকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
নরমাংস দগ্ধ হলে তার গন্ধ অসহ্য বোধ হয়। শস্ত্রধারী সৈন্য দলটি স্থান ত্যাগ করে একে একে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। কেন, কেন, প্রশ্ন তখনও ছিলো। বিষ্ণুদাস মিত্র হরিসেনের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা। তার দৃষ্টিতে সৈন্যদলের চঞ্চল আচরণ বিসদৃশ মনে হয়। সে হরিসেনের কাছে তার সন্দেহের কথাটি ব্যক্ত করে। ওদিকে তখন শুদ্ধানন্দকে সভামঞ্চে আনয়ন করা হয়েছে। ঘোষক ঘোষণা করে দিয়েছে যে, এই পামর যদি সমবেত সামন্তদের পাদুকা লেহন করে, তবে একে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে।
ঐ কথার যে কী অর্থ, শুদ্ধানন্দের চেতনায় তার কোনো ছায়াপাতই ঘটছিলো না। সে বিমূঢ় পশুর মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার আচরণ হাস্যকর মনে হচ্ছিলো। ঐ সময় কে যে চিৎকার করে ওঠে বোঝা যায় না। শুধু চিৎকারটি শোনা যায়–ওর কি দোষ? ওর কি অপরাধ? এবং তাতেই সভামঞ্চের লোকেরা পরস্পরের মুখপানে চায়। এই মুহূর্তে কে একজন ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের পশ্চাদ্দেশে সজোরে পদাঘাত করে। শুদ্ধানন্দ পতিত হন জনসমষ্টির মধ্যে। এমন মনে হচ্ছিলো যে লোকটিকে ক্ষিপ্ত জনতা ছিন্নভিন্ন। করে দেবে। কিন্তু তা হয় না। বরং দুজন লোক শুদ্ধানন্দকে তুলে দাঁড় করায়। একজন বলে, যা, শীঘ পলায়ন কর।