তা সকলের সুখ সম্পাদন কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? ভগবান যাকে শূদ্র জন্ম দিয়েছেন পূর্ব জন্মের পাপের নিমিত্ত, সেখানে মানুষ কী করতে পারে? ভবিতব্য খণ্ডাবে মানুষের কি এতোই সাধ্য?
০৬. উজুবট গ্রামে ঐ সময়ে
উজুবট গ্রামে ঐ সময়ে একদা মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাসের আগমন ঘটলো। শোনা যায়, সে পূর্বদেশ অঞ্চলে বাণিজ্য যাত্রায় গিয়েছিলো। তবে নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন না করে, কেন শ্বশুরালয়ে তার আগমন ঘটলো সেই রহস্য উদ্ধার করা গেলো না। বিশেষত দীনদাস ঘটনাটি সহজভাবে মানতে পারলেন না।
মায়াবতী অতিশয় উফুল্লা, যোগমায়াও জামাতার শ্রীমুখদর্শনে তুষ্টা। শুকদেব জামাতাকে আপ্যায়নের জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে তাঁর মনে ভিন্ন প্রশ্নের উদয় আর হলো না। কিন্তু দীনদাসের মনে চিন্তাটি থেকেই গেলো। তিনি স্বল্প বিচলিতও বোধ করলেন, যখন একদা দেখলেন যে, চারজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু জামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলো। ভিক্ষুরা অবশ্য বিলম্ব করেনি, সামান্য কিছুক্ষণ অবস্থান করেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তবু দীনদাস উদ্বিগ্ন রইলেন।
একাকী শুধু দীনদাস নয়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আরও দুএকজন হিতাকাক্ষী ব্যক্তি ভিক্ষুদের সংবাদ নিতে আসেন। কেউ কেউ অনুসন্ধান পর্যন্ত করে যান, সত্যি সত্যি। ভিক্ষুরা বিদায় নিয়েছে কিনা। ইতোমধ্যে শোনা যায়, দূরস্থিত জনপদগুলিতে পর্যন্ত মানুষকে নাকি সন্ত্রস্ত এবং আতঙ্কিত দিনযাপন করতে হচ্ছে। এখন সদ্ধর্মী ভিক্ষু দেখলেই মানুষ প্রমাদ গণনা করে।
ঘটনাটি এইরূপ:
সামন্ত হরিসেন তাঁর অঞ্চলের হাটগুলিতে কর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহত্ত্ব ছিলো–একটি মন্দির নির্মাণের বাসনা তার। প্রথমতঃ বৃহৎ বণিকদের উপরই এই কর আরোপিত হয়। কিন্তু সামন্ত প্রভুর দাস এবং কৃপাভোগীদের উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে ক্ষুদ্র বণিকদেরও আর নিষ্কৃতি রইলো না। তারা ক্ষুদ্রবিত্ত বণিকদের নিকট থেকেও কর গ্রহণ করতে লাগলো। কর অনাদায়ে সমূল পণ্য আত্মসাৎ, অহেতুক শাস্তি প্রদান, সামান্য কারণে লাঞ্ছনা গঞ্জনা–এই সকল ঘটতে আরম্ভ করলো। ফলে ক্রেতা–বিক্রেতা উভয় পক্ষেই সৃষ্টি হলো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার।
ঐ সময়ই অকস্মাৎ ঘটনাটি ঘটে।
ঘটনা সামান্য, কিন্তু ঐ সামান্য ঘটনাই একটি প্রচণ্ড, নিষ্ঠুর এবং ব্যাপক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। সমিধ প্রস্তুত থাকলে ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গই যে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?
হাটের একপ্রান্তে কর্মকারদের বিপণী। কর্মশালার অদূরে ডোম ও চণ্ডাল শ্রেণীর রমণীরা তাদের হস্তনির্মিত পণ্যাদি–যেমন চাঙাড়ি, খুচি ডুলা, টুকরি এইসব বিক্রয় করে। কয়েকটি ডোমনী যুবতী পিপ্পলী হাট অঞ্চলে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো। এতে উগ্র–ক্ষত্রিয় হরিসেনের প্রধান অনুচর বজ্রসেনের ডোমনীদের উপর বিশেষ ক্রোধ ছিলো। ঐ দিন বজ্ৰসেন তার সহচরদ্বয় সমভিব্যহারে হাটে সদম্ভে বিচরণ করছিলো। ঐ প্রকার বিচরণকালে হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে যে দুজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু ডোম যুবতীদের সঙ্গে হাস্যালাপে রত। দুটি যুবতী, বিশেষ করে কলহাস্যে এমনই বেপথু হচ্ছিলো যে তাদের উর্ধাঙ্গের বসন বারবার বিস্রস্ত হয়ে পড়ছিলো। সে দৃশ্যে বজ্রসেন কি দেখেছিলো ঈশ্বর জানেন, সে হুঙ্কার দিয়ে অগ্রসর হয় এবং ডোমনীদের কাছে গিয়ে তাদের পণ্যের মূল্য জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ডোমনীদের তখনও উল্লাসঘোর কাটেনি, অঙ্গে হাস্য তখনও তরঙ্গায়িত হচ্ছে এবং কোনোদিকেই তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। সম্ভবত বজ্রসেনের কথা তারা শুনতেও পায়নি। ঐ সময় ক্ষুব্ধ বজ্রসেন চিৎকার করে বলে ওঠে, ওরে পামরি, হট্টকর দিয়েছিস?
অধিক আর কি! ডোমনীটি যুবতী, তায় রূপসী এবং সর্ববিষয়ে পারঙ্গমা। ঊর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্রাঞ্চল কটিলগ্ন ও দুহাতের পিত্তল বলয় চমকিত করে বলে ওঠে, কিসের কর, আমরা কেন হট্টকর দিতে যাবো?
তুই কেন শূকরপুত্রী, তোর পিতা দেবে।
অ–অ, বজ্রসেনের দিকে ঐ সময় অন্য ডোমনীরা কটিদেশে বস্ত্রাঞ্চল বন্ধন করে এগিয়ে আসে। একজন ডেকে বলে, হ্যাঁ লো কুসুম, কি বলে ঐ দগ্ধমুখ মর্কট!
কুসুম তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলে ওঠে, অরে ছিনাল পুত্র, আমরা যে তোর পিতার কর্মস্থলের দ্বারদেশ থেকে তোকে টেনে এনে জগৎ দেখাবার সময় কর দিয়ে এসেছি, সে সংবাদ কি তোর মা তোকে জানায়নি?
বজ্রসেনের ব্রহ্মতালু পূর্ব থেকেই দাহ্য হয়ে উঠেছিলো, ডোমনীর ঐ কথায় সেখানে যেন অগ্নিসংযোগ হলো। সে এক লম্ফে কি বললি, কি বললি এই কথা উচ্চারণ করে। এবং সজোর মুষ্টিতে কেশ আকর্ষণ করে কুসুম ডোমনীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে।
অন্য ডোমনী ও ডোমেরাও ঘটনাস্থলে ইতোমধ্যে এগিয়ে আসে। কর্মকার বিপণীগুলিতে ঠকঠক ঠনঠন শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। সকলেই বিস্ফারিত নয়নে দেখতে থাকে, অতঃপর কী ঘটে। ভিক্ষু চেতনানন্দ ঐ সময় নিকটস্থ হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। আবেদন জানান, মহাশয়, স্ত্রীদেহে ক্ষত্রিয়ের আঘাত শোভা পায় না, আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। ভিক্ষুর ঐ কথায় হিতে বিপরীত হয়। বজ্ৰসেন তার কোষবদ্ধ অসি নিষ্কোষিত করে ভিক্ষু চেতনানন্দের স্কন্ধে আঘাত করে বসে। তাতে আহত চেতনানন্দ আর্তনাদ করে ভূমিতে পপাত হন। ঐ দৃশ্য সমবেত জনতাকে স্তব্ধ করে দেয় মুহূর্তের জন্য। কিন্তু মুহূর্ত মাত্র, তারপরই কে একজন চিৎকার করে ওঠে, ধর শ্যালককে