না বৎস, একজন হাসলো। বললো, শ্বশুরালয়ে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। কথাটি বলে দারুণ হাসিতে ফেটে পড়লো দুজনে।
কিন্তু অবাক কাণ্ড এই যে, তারা অতিথিশালার দিকে, যেখানে সৈন্যদলটি বিশ্রামরত ছিলো, সেদিকে নিয়ে গেলো না। হাটের আরেক প্রান্তে একটি বটবৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়ালো। তারপর অকস্মাৎ রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললো, অরে সদ্ধর্মী কীট, তোর গুপ্তচর বৃত্তির কি পরিণতি হয় এখনই দেখতে পাবি। এখনও সময় আছে, বল, কি হেতু তোর এই হাটে আগমন? পিপ্পলী হাটে তোরাই কি মহাসামন্ত হরিসেনের পরিজনদের উপর আক্রমণ করিসনি? তোরাই কি মূল দ্রোহকারী নোস?
শ্যামাঙ্গ এবার অনুমান করতে পারে যে পিপ্পলী হাটে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৈনিক পুরুষ দুটির অভিযোগের উত্তরে কী বলবে, সে ভেবে উঠতে পারে না। অসহায়ভাবে একবার বামে একবার দক্ষিণে তাকায়। এবং ঐ তাকাবার সময় দূর থেকে বিপণীকারকে দেখতে পায়। দেখে, বিপণীকার বারবার নিজ কটিদেশ স্পর্শ করে একটি মুদ্রা দেখিয়ে ইঙ্গিত করছে। সে বুঝে নিলো, কিছু উৎকোচ দিলে হয়তো সে। নিষ্কৃতি পেতে পারে। চকিতে তার মস্তিষ্কে নতুন বুদ্ধি খেললো। খুবই কাতর স্বরে সে জানালো, মহাশয়রা, বিশ্বাস করুন, আমি বৌদ্ধ নই, আমার চতুর্দশ পুরুষ কেউ সদ্ধর্মী ছিলো না। আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাদের কাছে বলছি–কিছুই গোপন করবো না। তার আগে অনুমতি দিন, ঐ বিপণীকারের কাছে আমার কিছু অর্থ গচ্ছিত আছে, সে অর্থ। নিয়ে আসি।
ঐ কথায় কাজ হয়। দুজনেই উৎসাহী হয়ে ওঠে। একজন বলে, নিজ অর্থ অন্যের কাছে কেউ রাখে? তুই দেখছি, একটি উৎকৃষ্ট গর্দভ। যা, তোর কি গচ্ছিত আছে, নিয়ে আয়।
শ্যামাঙ্গ দ্রুত বিপণীর অভ্যন্তরে ছুটে গেলো। এবং অন্তরালে অবস্থান করে ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ কটিবদ্ধ স্থলী থেকে অর্ধাংশ ভূমিতে রেখে অন্য অর্ধাংশ স্থলীসুদ্ধ হাতে নিয়ে সৈনিক পুরুষদের কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, এবার চলুন মহাশয়রা।
কয়েকপদ অগ্রসর হতে না হতেই একজন জানতে চাইলো, তোমার স্থলীতে কি পরিমাণ অর্থ হে?
অতীব সামান্য মহাশয়।
কত?
তা দুই কুড়ি মুদ্রা হতে পারে।
শ্যামাঙ্গের উত্তরে কিছু বুঝলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে কয়েকপদ অগ্রসর। হয়েই তারা আবার দাঁড়ালো। একজন এবার বললো, তোমার কিন্তু প্রাণসংশয় হতে পারে, আমাদের প্রভুর ক্রোধ চণ্ডালের মতো।
শ্যামাঙ্গ এবার আরও বিনয় প্রদর্শন করে। বলে, মহাশয় আমি আপনাদের দাস বই অন্য কিছু নই–আপনারা রাজপাদোপজীবী–আপনাদের অসীম ক্ষমতার বলে আমার মতো দীনহীন দাসের জীবন রক্ষা পাবে। আপনারা দয়া করুন, প্রভু!
তাহলে আমরা যে প্রভু তা তোরা স্বীকার করিস?
হ্যাঁ মহাশয়। শুধু আমি কেন, আমার চতুর্দশ পুরুষ স্বীকার করে।
প্রমাণ? প্রমাণ দেখাও
প্রভু এই যে আমি মস্তক নত করে বলছি, এই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
না, দক্ষিণা কোথায়? জানিস না, প্রভুকে প্রণামের সঙ্গে দক্ষিণা দিতে হয়?
স্পষ্ট কথা। শ্যামাঙ্গ ঐ কথার পর ভূমিতে উপবেশন করে। তারপর স্থলীর মুদ্রাগুলি ভূমিতে রেখে দুই ভাগ করে। শেষে এক ভাগ একজনের হস্তে তুলে দিয়ে বলে, মহাশয়, আমার যা ছিলো, তার অধিকাংশই আমি দক্ষিণা স্বরূপ দিচ্ছি, আপনারা দয়া করে গ্রহণ করুন।
আর ঐ অর্ধাংশ? খর্বকায় সৈনিক পুরুষের কণ্ঠস্বরে নিদারুণ অসন্তোষ।
মহাশয়, শ্যামাঙ্গ মিনতি জানায়, এ সামান্য অর্থের বড়ই প্রয়োজন, আমার গৃহে পুত্রকন্যা রয়েছে।
আর মূর্খ, একজন প্রবল উম্মাভরে বলে, স্বয়ং জীবিত থাকলে তবে না পিতৃনাম! অন্য সৈনিকটির রসবোধ প্রচুর। সে বলে, জালিকের গল্পটি জানা আছে তোর?
শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালে সৈনিকটি বলে, তবে শোন–একদা এক জালিক মৎস্য শিকারে নির্গত হয়ে রাত্রির প্রথম যামেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। এদিকে তার প্রত্যাবর্তনের কথা পরদিবস দ্বিপ্রহরে। জালিক পত্নী কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় যে অন্যের জলাশয়ে মৎস্য শিকার করার অপরাধে তাকে অর্থদণ্ড দিয়ে চলে আসতে হয়েছে। এ দুঃসংবাদ শুনে জালিক গৃহিণী অতিশয় কুপিতা হয়ে বলে, অর্থ দিয়েছে। ভালো–কিন্তু দণ্ডটি দিতে গেলে কেন?
গল্পটি অতিশয় অশ্লীল। শ্যামাঙ্গ বুঝেও না বোঝার ভান করলে সৈনিক পুরুষটি আবার। ব্যাখ্যা করে বলে, গৃহিণীকে এই জালিকের গল্পটি বুঝিয়ে বলিস এবং জানাস যে অর্থ গিয়েছে, কিন্তু দণ্ডটি তোর অক্ষতই আছে, তাহলেই দেখবি গৃহিণীর আর কোনো ক্ষোভ নেই।
ঐ কথার পর সৈনিক পুরুষ দুজন শ্যামাঙ্গের হাতের স্থলীটি নিয়ে চলে গেলো। আর তৎক্ষণাৎ শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের নিকট প্রত্যাগত হয়ে সেখানে রেখে যাওয়া মুদ্রা কটি নিয়ে অতিদ্রুত নবগ্রাম হাট ত্যাগ করলো। তার তখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। যে পথে এসেছিলো সেই পথেই সে ফিরে চললো। সে জানে না, গৃহে প্রত্যাগমন তার আশু সম্ভব হবে কি না।
পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ–ভাগের জনপদগুলির তখন প্রায় এরূপই অবস্থা। গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে মহামহিম পরম ভট্টারক শ্রী লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। রাজসভায় উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূৰ্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। জয়দেবের কৃষ্ণলীলার বর্ণনা শ্রবণে সভাসদবর্গ তুরীয়ানন্দে বিহ্বল, ধোয়ীর পবনদূতের বর্ণনায় কামকলানিপুণা রমণীকুলের উল্লেখে স্রোতৃবর্গ অহো অহো উল্লসিত স্বর উচ্চারণ করে উঠছেন। স্মার্ত পণ্ডিতের ভাগবত বিশ্লেষণে মুহুর্মুহু। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধু সাধু রব। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্দেহ করা হচ্ছে, যবন কেন্দ্রগুলিতে। কেন তাদের যাতায়াত, গূঢ় পুরুষেরা বিচিত্র সংবাদ আনছে। তথাপি প্রজাকুল সুখী। ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন, তো কালই বললেন, দূর হ, দূর হ, পামরের দল।