নৌযানটি বৃহৎ নয়, তবে এই স্বল্প পরিসর নদীতে ওটিকে বৃহৎই দেখাচ্ছিলো। যাত্রী এবং নানাবিধ সামগ্রীতে পূর্ণ হয়ে রয়েছে বলে অনুমান হলো। কারণ যাত্রীদের অনেকেই আচ্ছাদনীর বাইরে বসে আছে। নৌযানটির বহির্দেহে নানান কারুকার্য। ঐ প্রকার কারুকার্য সে আত্রেয়ী তীরে কখনও দেখেনি।
প্রৌঢ় পথিক তখনও নৌকায় আরোহণ করেননি। তার মধ্যে কেমন ইতস্তত একটি ভাব। কি ভাবছিলেন তিনিই জানেন। শেষে কাছে এসে জানতে চাইলেন, আপনি সুস্থ বোধ করছেন তো? ভেবে দেখুন, আমাদের সঙ্গে যাবেন কিনা। আপনি একাকী, তায় এমন অপরিচিত স্থান
শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো ঐ সময়, প্রৌঢ়ের চক্ষু দুটিতে বড় মায়া। প্রিয়জনের জন্য আন্তরিক উদ্বেগ ফুটে আছে তার মুখভাবে। সে বললো, অহেতুক উদ্বিগ্ন হচ্ছেন আপনি, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
ঐ কথার পরও প্রৌঢ় আশ্বস্ত হলেন কি না বোঝা গেলো না। খুব ধীর পদক্ষেপে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে, তিনি নদীর দিকে অগ্রসর হলেন।
প্রৌঢ়ের গমন পথের দিকে দৃষ্টি রেখে শ্যামাঙ্গ ক্ষুদ্র একটি নিঃশ্বাস ফেললো। ঐ মুহূর্তে নিঃসঙ্গ লাগলো নিজেকে। সে উঠে বসলো। এইভাবে শয়ান অবস্থায় সে কতক্ষণ থাকবে? তার এবার ওঠা উচিত। একাকিত্বই তার ভবিতব্য। কখনও তো সে সঙ্গলাভ করতে পারেনি। গুরুদেব তাকে ত্যাগ করেছেন, সতীর্থ বন্ধুরা তার সঙ্গী হয়নি কখনও, আর এ তো মাত্রই দণ্ড দুয়েকের সান্নিধ্য। তবে ভারী সজ্জন এদেশের লোক। বিশেষত প্রৌঢ়টি একেবারেই আপনজনের মতো আচরণ করছিলেন। তার মনে হলো, প্রৌঢ়ের কথা শুনলেই হয়তোবা তার জন্য ছিলো ভালো।
দ্বিতীয় দীর্ঘ নিঃশ্বাসটি নির্গত হওয়া মাত্রই সে নিজেকে ধরে ফেললো। বুঝলো, তার মনের মধ্যে আশ্রয় লাভের একটি বাসনা আবার জেগে উঠতে চাইছে। আসলেই কি তার লতার স্বভাব? সহকার শাখা দেখলেই অবলম্বনের জন্য লোলুপ হয়ে ওঠে? ধিক তোকে, ধিক দুর্বলচিত্ত কাপুরুষ! তোর শিক্ষা হয় না এতো কিছু কাস্ত্রে পরও। ঐ একাকী নদীর বটতলে বসে বসে সে নিজেকে ধিক্কার দিতে আরম্ভ করলো।
কিন্তু তখনও বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেনি।
সে পশ্চাতের দৃশ্যাবলীতে মনোনিবেশ করেছে তখন। না, নৌকাটির দিকে সে আর দৃষ্টিপাত করবে না। সে দেখছিলো দুটি বালককে। দূরের বৃক্ষতলে দণ্ডগুলি খেলায় তারা মত্ত। ভাবছিলো, বালক দুটিকে ডাকলে কেমন হয়। ঐ সময় দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতেই সে দেখলো, প্রৌঢ় ব্যক্তিটি আবার উঠে আসছেন। এ আবার কি কাণ্ড! লোকটির মস্তিষ্কে কি দোষ আছে? নৌকা ওদিকে প্রস্তুত–আর উনি চলে আসছেন? তার মনে কৌতূহল জাগ্রত হয়।
পশ্চাতে একজন যুবক চিৎকার করে ডাকছে, তবু প্রৌঢ়ের ভ্রূক্ষেপ নেই।
তার মনে হলো, লোকটি বোধ হয় তাকে নিয়ে যাবার জন্য আসছেন। সে মনে মনে কঠিন হলো। না, আর সে পরনির্ভর হতে যাবে না। প্রৌঢ়টি নিকটে এলে সে হাসলো, কি সংবাদ, আবার যে ফিরলেন?
হ্যাঁ ফিরলাম, তোমার ব্যাপারে নিশ্চিত বোধ করতে পারছি না।
এবার শ্যামাঙ্গ উঠে দাঁড়ালো। বললো, দেখুন আপনার বিশ্বাস হয় কিনা–আমি প্রকৃতই এখন একজন সুস্থ ব্যক্তি।
শ্যামাঙ্গকে দেখতে লাগলেন প্রৌঢ়টি। তাঁর দৃষ্টি যেন সরতে চায় না। হঠাৎ জানতে চাইলেন, বৎস, কিছু মনে করো না, তুমি সম্বোধন করছি বলে, সত্যিই কি তুমি আত্রেয়ী তীরের লোক?
এ আবার কি রহস্য! শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়। বলে, এ আপনি কি বলছেন? আপনাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার কি লাভ?
প্রৌঢ় অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, আমার কেমন মনে হচ্ছে তোমাকে একাকী রেখে যাওয়া আমার উচিত নয়। তুমি আমাদের সঙ্গে চলো–দুদিন আমরা তঙ্গন তীরের মেলায় অবস্থান করবো। তারপরই আবার ফিরে আসবো। তোমার মন্দ লাগবে না, এ অঞ্চলের মেলায় নানান উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক ক্রিয়াকারে সমাবেশ হয়।
শ্যামাঙ্গ হাসলো, না মহাশয়, সত্বর গৃহে ফেরা আমার বিশেষ প্রয়োজন।
প্রৌঢ় অধোমুখে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার শ্যামাঙ্গের মুখোমুখি হলেন। বললেন, তুমি বিরক্ত হয়ো না বস। একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, অর্থ–সামগ্রী কিছু আছে তো তোমার? না হলে কিন্তু পথিমধ্যে বিপদ হতে পারে।
শ্যামাঙ্গের এতোক্ষণে যেন সম্বিৎ হয়, সত্যিই তো, ও চিন্তা তো তার মস্তিষ্কে আসেনি। সে কটিদেশে দুহাত স্পর্শ করে আশ্বস্ত হয়না, কটিবন্ধনে স্থলীটি অক্ষতই আছে। বললো, আমার সঙ্গে কিছু পাথেয় অবশ্যই আছে–কিন্তু আমি কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না–আপনি আমার প্রতি এতো স্নেহশীল হয়ে উঠেছেন যে
প্রৌঢ় শ্যামাঙ্গের কৃতজ্ঞতা–ভাষণ সম্পূর্ণ শুনলেন না। বলে উঠলেন, বস, তোমাকে কি বলবো বলো, আমি একজন হতভাগ্য পিতা। আমার একটি বন্ধু পুত্র ছিলো–নিজের পুত্র নেই–ওকেই আমি পুত্রবৎ স্নেহ করতাম, আমার কন্যাটিও ওকে বড় ভালবাসতো, কিন্তু গত বছর এমনই সময়ে দস্যুহস্তে সে–
আর বলতে পারলেন না। বাকরুদ্ধ অবস্থায় থাকলেন কিছুক্ষণ। ক্ষণেক পরে আবার বললেন, আমার কন্যা বিশ্বাস করে না যে সে নেই–সে অপেক্ষা করে আছে, চন্দ্রদাস ফিরে আসবে এবং তার বিবাহ হবে।
প্রসঙ্গটি করুণ। প্রৌঢ় পথিকের আবেগ বিহ্বল ভাব, তাঁর মুখের তুমি সম্বোধন এবং সর্বোপরি শ্যামাঙ্গের জন্য তাঁর উদ্বেগ বিচলিত করে দিলো শ্যামাঙ্গকে। সে কী বলবে ভেবে উঠতে পারছিলো না। বিমূঢ় দৃষ্টিতে সে প্রৌঢ়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এই প্রৌঢ়কে কী বলবে সে? তাকে অবলম্বন করে তাঁর ব্যাকুল চিত্ত হয়তো উদ্বেল হয়ে উঠেছে। নিজের কন্যার বেদনা–ভার বহন করতে করতে তাঁর হৃদয় ক্লান্ত, এখন যদি তাঁর আশা হয়ে থাকে যে, বান্ধবহীন স্বজনহীন একাকী পথিক তার বেদনার ভার কিছুটা লাঘব করতে পারবে, তাহলে কি সেটা তার অপরাধ?