শ্যামাঙ্গের মস্তিষ্কে উত্তেজনাকর সংবাদ প্রবেশ করতে চায় না। সে বুঝতে পারছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণেই এখানে হাট বসেনি। সেই কারণেই গো–মহিষের শকটাদিও আসেনি। এখন সে কীভাবে স্বগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করবে, সেটাই সমস্যা। সে বললো, হাটে কি কেউ আসেনি? দূরের বণিকেরা?
বিপণীকার হাসে, মহাশয় অবোধের মতো প্রশ্ন করছেন। এরা গতকাল কয়েকটি শকটের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে–তারপর আর কে আসবে হাটে, বলুন? সবাই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেছে। আপনাকে পদব্রজেই যেতে হবে–তবে বিল্বমূলেই প্রত্যাগমন করা বোধ হয় আপনার জন্য মঙ্গল। শোনা যাচ্ছে, এদের পশ্চাতে আরও একটি বাহিনী আসছে, পথিমধ্যে আপনি তাদেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতে পারেন। এরা তো মানুষ নয়, কখন কি করে কিছুই স্থির নয়।
বিপণীকারের ভ্রূতে কুঞ্চনরেখা। সেখানে কখনও বিরক্তি প্রতিফলিত হচ্ছে, কখনও ঘৃণা। বললো, এদের আসবপানের আগ্রহ দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। মনে হবে না যে এরা জলপান করতে জানে। ডোমপল্লীর কাছাকাছি প্রয়োজনেও কেউ যেতে পারছে না। বৃদ্ধ, যুবক এবং শিশুরা নিকটস্থ বনে আশ্রয় নিয়েছে। ঐ অতিথিশালার নিকটে গেলে আর চক্ষু মেলে রাখতে পারবেন না। শূকরপুত্রদের ঐ সমস্ত আচরণ চক্ষু মেলে দেখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। দলপতিটি সর্বক্ষণ রক্তনেত্র। গতকাল থেকে দুটি যুবতী ডোমনী নির্বস্ত্র হয়ে তার অঙ্গ সংবাহন করে চলেছে–আর গবাক্ষ পথে সাধারণ সৈন্যরা ঐ দৃশ্য উল্লাস ভরে চেয়ে চেয়ে দেখছে, একেবারেই নরকের কীট!
বিপণীকার উত্তেজিত হয়ে উঠলো বর্ণনা করতে করতে। ক্ষুব্ধস্বরে এক সময় বললো, এই পাপাচার কি সহ্য করা যায়, বলুন? আপনি কি কদাচ শুনেছেন যে রাজপুরুষেরা এইরূপ কদাচারে নিমজ্জিত থাকে?
শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না। শুধু সে কেন, অনেকেই শুনেছে, রাজপুরুষদের বিলাসী আচরণের নানান কাহিনী। রাজপুরুষ কিংবা তাদের অনুচরদের এইরূপই তো এখন আচরণ। তার মনে পড়ে, লক্ষ্মণাবতীর এক শিল্পী রাজপুরুষদের বহু প্রকার কাহিনী বর্ণনা করেছিলো। সামন্ত ও মহাসামন্তেরা নাকি রাজকার্য ব্যপদেশে রাজধানীতে গমন করলে নগর নটিনীর গৃহে অষ্টপ্রহর যাপন করে এবং কদাচ জলপান করে না।
শ্যামাঙ্গের ঐ সময় বৎস রাজা উদয়নের কাহিনীটি স্মরণ হয়। রমণী সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে বলে প্রজাদের রাজদর্শনের সুযোগটুকু পর্যন্ত তিনি দিতেন না। গবাক্ষপথে একটি পদাঙ্গুলি শুধু উত্তোলন করতেন আর তাই দর্শন করে প্রজাদের তুষ্ট থাকতে হতো। শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের কাছে কাহিনীটি বললো না। শুধু ক্ষুদ্র মন্তব্য করলো, পিপ্পলী গ্রামের অধিবাসীদের দেখছি ঘোর বিপদ সমাসন্ন। ক্ষণকাল পর সে আবার বললো, আপনারাও যে নিরাপদ, এমন কথা কিন্তু চিন্তা করবেন না।
মহাশয় কি আমাকে নির্বোধ ভাবছেন? বিপণীকার বললো, আমি দুইবার এ স্থান ত্যাগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু শূকরপুত্ররা দুইবারই পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখলেই বলে, তোমার ভয় নেই, তুমি নির্ভয়ে থাকো। কিন্তু আমি জানি, ডোমপল্লীর রমণী এবং মধুকাসবের আকর্ষণ কিঞ্চিৎ শিথিল হলেই তারা গৃহস্থ পল্লীতে প্রবেশ করবে এবং তখনই হবে আমার বিপদ।
শ্যামাঙ্গ নিজেও বুঝছিলো যথাশীঘ্র তার নবগ্রাম ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু কোন পথে যাবে তাই সে স্থির করতে পারছিলো না। বললো, আমি কোন পথে যাবো, বলতে পারেন?
এই পর্যন্ত বলতে পারলো সে। ঠিক ঐ সময় দুজন সৈনিক পুরুষ নিকটে এসে দাঁড়ালো।
একজন কৃষ্ণবর্ণ, খর্ব কিন্তু স্ফীতকায়। অন্যজন গৌর, দীর্ঘ এবং কিঞ্চিৎ বয়স্ক।
ওহে, একজন বিপণীকারকে সম্বোধন করে বলে, লোকটিকে নতুন দেখছি যেন?
বিপণীকার শঙ্কিত দৃষ্টিতে বারেক শ্যামাঙ্গের দিকে তাকায়। তারপর বলে, মহাশয়, প্রভু, ইনি পথিক, আত্রেয়ী তীরের অধিবাসী।
দীর্ঘদেহ সৈনিক পুরুষ শ্যামাঙ্গের দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কি হে, কি পরিচয় তোমার?
মহাশয়, শ্যামাঙ্গ সবিনয়ে জানায়, অধমের নাম শ্যামাঙ্গ, হেমাঙ্গদাস আমার পিতা, আমরা মৃৎশিল্পী, আত্রেয়ী তীরের রজতপীঠ গ্রামে আমার নিবাস।
অ, তুমি তাহলে কুম্ভকার পুত্র, বেশ ভালো কথা–খর্বকায় সৈনিক পুরুষটির কৌতুক প্রকাশ পায়। বলে, তা কুম্ভকার পুত্রের হঠাৎ পরদেশ গমন কেন?
শ্যামাঙ্গকে তখন কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। তার কথা শুনে দুজনের মুখেই অবিশ্বাসের হাসি দেখা যায়। একজন কপট কৌতুকে বলে উঠে, ভালো ভালো–অতি চমৎকার তোমার উদ্ভাবন, বসুদেব তাহলে মূর্তি নির্মাণ পরিত্যাগ করে কুম্ভকার বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। অতি উত্তম কল্পনা তোমার। এখন সুবোধ বালকের মতো চলো। দেখি, আমরা তোমার প্রকৃত পরিচয়টি উদ্ধার করতে পারি কি না।
এ প্রায় অবিশ্বাস্য কাণ্ড। শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়ে যায়। সে কি চোর না দস্যু? এভাবে বন্দী করবে? সে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। বলে, মহাশয়রা বিশ্বাস করুন, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার কোনো লাভ নেই।
হ্যাঁ, বৎস, আমরা বালক নই–সবই বুঝতে পারি। শুধু বুঝতে পারি না, কিছু কিছু কাজও করতে পারি–পিতৃনাম বিস্মরণ মানুষের কি প্রকারে হয় জানো?
বিদ্রূপটি স্থূল এবং অপমানজনক। কিন্তু শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না, নিজ মস্তিষ্ক শান্ত রাখে। সে বুঝতে পারছিলো, এ সব সাধারণ সৈনিকের কাছে ক্রোধ প্রকাশ করা প্রকাণ্ড মূর্খতা। সে ভাবছিলো, বরং দলপতির কাছে নিয়ে যাক আমাকে, উধ্বর্তন রাজপুরুষেরা নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝবেন। সে জানতে চাইলো, মহাশয়রা কি আমাকে বন্দীশালায় নিয়ে যাচ্ছেন?