অবশেষে লীলাবতী পিতৃগৃহে এলো। এবং সেই যে এলো তারপর বৎসরাধিককাল হতে চললো। অভিমন্যুর কোনো সংবাদ নেই।
লীলাবতী মাতুলের সব কথাই শুনেছে। রাষ্ট্রবিপ্লব সম্পর্কে তার ধারণা নেই, যুদ্ধ কাকে বলে তাও সে কল্পনা করতে পারে না। তবে আসন্ন কোনো বিপদের আশঙ্কা যে তার মাতুল করছে, সেটা সে বুঝতে পারে এবং সে জন্য তার যে স্বামীগৃহে অবস্থান করা উচিত, সেটা বুঝতেও তার অসুবিধা হয় না। কিন্তু এইখানেই তার বিদ্রোহ। প্রলয় যখন হবে তখন কে বাচবে, কে মরবে, তার কোনো স্থিরতা নেই। বাচবো বলে কৌশল অবলম্বন করলেই যে বাঁচা যাবে, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সুতরাং ও চেষ্টা কেন? সে স্থির করে, পিতৃগৃহ ত্যাগ করে সে কোথাও যাবে না।
০৫. শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে
শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে যখন উপনীত হলো তখন চৈত্রের প্রখর পশ্চিমা বাতাস এবং রৌদ্রতাপ তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। হাটের মধ্যস্থলে প্রাচীন একটি বটবৃক্ষ এবং বৃক্ষতলে বিপণী। সে ছায়াতলে ক্ষণেক বসলো। অদূরে দীর্ঘিকা–কাকচক্ষু স্বচ্ছ জল তাকে স্নিগ্ধ আহ্বান করতে থাকলে সে তীরে নেমে যেতে বাধ্য হলো।
জল অতিশয় শীতল, হস্তমুখ প্রক্ষালন শেষে আকণ্ঠ জলপান করে সে বৃক্ষতলে আবার এসে বসলো। অবাক লাগছিলো তার, হাট এমন পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে কেন? নাকি আজ হাটবার নয়? সে বামে দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করে। জনসমাগম নেই, গো–মহিষের শকটাদি থাকার কথা–একখানি শকটও তার দৃষ্টিপথে আসে না।
ঐ সময় বৃক্ষতলের বিপণীকার, ব্যবসায়ের আশায়, নাকি নিতান্তই সৌজন্যবশে, বলা কঠিন, অতীব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কাছে এসে বসলো এবং জানতে চাইলো, মহাশয় কি দূরে যাবেন?
শ্যামাঙ্গ প্রীত বোধ করে বিপণীকারের ঐ স্নিগ্ধ সম্বোধনে। সে তার গন্তব্যের কথা জানায়। তারপর জানতে চায়, বিপণীতে আহার্য বস্তু কী আছে। শ্যামাঙ্গের ক্লান্ত মুখ দেখে বিপণীকার দ্রুত হস্তে একটি পদ্মপত্র এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনি বসুন, আমি ফলাহারের ব্যবস্থা করছি।
ফলাহারটি সত্যিই উপাদেয়। সুগন্ধী এবং কোমল চিপিটক, প্রগাঢ় দধি, তৎসহ খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং স্ফীতাঙ্গ, প্রায় বর্তুলাকার, হরিদ্রাভ কদলী। পরম পরিতোষের সঙ্গে আহার সমাপ্ত করে আচমন শেষে যখন বিপণীকারের কুশাসনটি বিস্তৃত করেছে, বাসনা, ক্ষণকালের জন্য লম্বমান হবে–ঐ সময়ই বিপণীকার বিশ্রম্ভালাপের জন্য কাছে এসে বসলো। হাতে করে নিয়ে এসেছে পর্ণ ও গুবাক।
শয়ন আর হলো না। শ্যামাঙ্গ উঠে বসলো। বুঝলো, লোকটি আলাপপ্রিয়। বিপণীকার জানতে চাইলো, নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে আসছেন?
হ্যাঁ, বিল্বমূল গ্রাম থেকে আসছি, বিল্বমূল গ্রাম কি এই স্থান থেকে অধিক দূর?
বিপণীকার হাসে, মহাশয়ের দূরত্ব জ্ঞান দেখছি প্রখর।
কেন? শ্যামাঙ্গ ঈষৎ বিব্রত বোধ করে।
বিল্বমূল কি এখানে? বিপণীকার জানায় এই নবগ্রাম হাটে বিল্বমূল গ্রামের বণিকেরা আসে–ওখানে নাকি একটি মন্দির নির্মিত হচ্ছে–ঐ বণিকেরাই বলে, শকট বাহনে গেলে বিল্বমূল এক দিন এক রাত্রির পথ।
আচ্ছা, হঠাৎ বিপণীকারের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়। নিম্নস্বরে, প্রায় অস্ফুটে, বলে, আপনি পিপ্পলী হাটের সংবাদ কিছু জানেন? কিছু শুনেছেন?
না তো, শ্যামাঙ্গ মস্তক হেলন করে। বলে, না, তেমন কোনো সংবাদ আমার কাছে আসেনি। আমি কোনো সংবাদ জানি না–আপনি কিছু শুনেছেন?
না, আমিও কিছু শুনিনি, বিপণীকার জানায়, তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে ওখানে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। উঠুন, একটি দৃশ্য দেখাবো আপনাকে–এই বলে সে শ্যামাঙ্গের হাত ধরে তার বিপণীর পশ্চাতে নিয়ে গেলো এবং বটমূলের অন্তরাল থেকে দেখালো, ঐ দেখুন।
শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে। দেখবার মতোই একখানি দৃশ্য বটে। অদূরেই অতিথিশালা এবং কূপ, কয়েকটি আম্রবৃক্ষও রয়েছে ইতস্তত। সমস্ত স্থানব্যাপী বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম–কেউ বসে, কেউ অর্ধ–শয়ান, কেউ, কৌতুক–ক্রীড়ায় রত। কয়েকজন শস্ত্রধারী পুরুষকে দেখে মনে হয় তারা প্রহরায় রয়েছে। প্রায় সকলের পরিধানেই বীরটিকা, হস্তে শূল, কটিদেশে কোষবদ্ধ তরবারি। অল্প কিছু দূরে নবীন একটি অশ্বত্থতলে আরও একটি দল। বোঝা যায় তারা ধানুকী। ধনুকগুলি বৃক্ষকাণ্ডে একত্রে রক্ষিত, ক্ষুদ্র শরাসন ও তৃণীরগুলি বৃক্ষ শাখায় লগ্ন অবস্থায় দুলছে।
দৃশ্যটি দেখে শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে, কোনো সামন্তপতি নিশ্চয়ই।
না, তবে মনে হয়, প্রকৃত রাজপাদোপজীবী কেউ–নতুবা এমন কেন হবে বলুন? ঐ যে, ধ্বজা আর পতাকা, দেখতে পাচ্ছেন?
কিন্তু এখন কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে এমন তো শুনিনি, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে। বলে, তবে কি দস্যু দমনের জন্য এই অভিযান?
হ্যাঁ, কী যে বলেন, বিপণীকারের কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়। বলে, এরা করবে দস্যুদমন! কাক কি স্বজাতির মাংস ভক্ষণ করে? বলুন?
ক্ষণকাল পরে বিপণীকার নিম্নস্বরে জানায়, একজন বলছিলো এরা নাকি পিপ্পলী হাটে যাচ্ছে সেখানে নাকি চণ্ডালেরা দ্রোহ উত্থাপন করেছে। কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি, তাই আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কিছু জানেন কিনা। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে সংবাদটা, কেন জানেন? দ্রোহকারী নাকি পুরুষ নয়, চণ্ডালদের রমণীরা এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছে–এ কি বিশ্বাস করা যায়? আপনিই বলুন?