যোগী সিদ্ধপা দক্ষিণদেশের কথা বিশেষ বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ভ্রাতা হরকান্ত–তোমাকে কি বলবো–মাতা বসুমতী পাপের ভার দীর্ঘকাল বহন করতে পারেন না। যা অবশ্যম্ভাবী, তাই হবে। পরম ভট্টারক মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের মুষ্টির বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি–কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তার পতন কেবল সময়ের প্রশ্ন।
হরকান্ত যোগী সিদ্ধপাকে দেখছিলেন। শুশ্রুমণ্ডিত মুখাবয়ব হলেও চক্ষু দুটি স্মরণ করতে পারেন। একদা ক্ষেত্রজীবী গৃহস্থ ছিলো এই যোগী পুরুষ। একমাত্র সন্তান পুত্রটিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। পুত্রটি কায়স্থ পল্লীতে খেলতে যেতো–এবং ঐ সময়ই কায়স্থ পল্লীর বালকেরা তাকে বর্ষায় স্ফীত পুনর্ভবার প্রবল স্রোতে নিক্ষেপ করে।
ঐ ঘটনায় দীননাথ উন্মাদপ্রায় হয়ে যায়, স্ত্রী কমলা উন্মাদিনী হয়ে পুনর্ভবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে–নাহ, সেই ঘটনা স্মরণ করতেও প্রাণ শিহরিত হয়। হরকান্তের রুগ্ন দেহে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি এতোকাল পর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। তার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট আরম্ভ হলো।
সিদ্ধপা নিজ ভগিনীপতিটির অবস্থা লক্ষ্য করছিলেন। বড় অসহায় অবস্থা এখন হরকান্তের। যদি তার মতো মুক্ত পুরুষ হতে পারতো তাহলে বেঁচে যেতো। কিন্তু তার যে আবার একটি কন্যা রয়েছে। সংসার তাকে ছাড়ে না, সে বেচারার উপায় কি? যদি সমস্ত কিছু ত্যাগ করে একবার বেরিয়ে আসতে পারতো হরকান্ত, তাহলে আর রোগ শোকে সে এমন বিকল হতো না।
সিদ্ধপা এক দিবস অবস্থান করলেন হরকান্তের গৃহে। এখান থেকে তিনি প্রথমে দক্ষিণে তারপর পূর্বে যাবেন। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আম্রপট্টলী গ্রামে যাবেন এবং জামাতার সন্ধান করবেন–তবে একটা কথা–সিদ্ধপা ভগিনীপতিকে পরামর্শ দেন, যদি সংবাদ পাওয়া যায় যে অভিমন্যু দাস স্বগ্রামেই অবস্থান করছে, তাহলে আর অপেক্ষায় না থেকে লীলাবতীকে সেখানে প্রেরণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
লীলা দ্বারান্তরাল থেকে মাতুলের উপদেশ শুনে মন্তব্য করলো, মাতুল বললেই হলো, আসুক দেখি, কে আসছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
তার সেই অপমান কেমন করে ভুলবে! কুসুম শয্যার রাত্রে লোকটা তার মুখ দুহাতের অঞ্জলিতে নিয়ে কেবলি বলছিলো, আমার বিশ্বাস হয় না–আমার বিশ্বাস হয় না।
অতি মৃদুস্বরে সে জানতে চেয়েছিলো, কি বিশ্বাস হয় না আপনার?
উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে মুখপানে চেয়েছিলো অভিমন্যু–আর বলেছিলো, বিবাহে বিশ্বাস হয় না, নারীতে বিশ্বাস হয় না, তোমাকে বিশ্বাস হয় না।
নববধূ স্বামীর মুখপানে চেয়ে ওষ্ঠদংশন করে মাত্র–অবগুণ্ঠন যেমন ছিলো তেমনি থেকে যায়। তার কিছুই করার থাকে না। ঐ লোকটি, যাকে সে মাত্রই এক দিবসকাল পূর্ব থেকে জেনেছে স্বামী বলে, সে তার মুখপানে কী দেখে ঈশ্বর জানেন। অভিমন্যু কি উন্মাদ? লীলাবতীর সন্দেহ হয়। বাইরে তখনও সম্পর্কিত আত্মীয়া রমণী ও বালিকারা কলহাস্যে মত্ত, আকাশে হেমন্তের জ্যোৎস্না। লীলাবতীর দুই চক্ষু অশ্রুময় হতে আরম্ভ করে। অভিমন্যু যখন তার কঞ্জুলিকার গ্রন্থিমোচন করতে যায় তখন সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে বলে–না। যখন অভিমন্যু আলিঙ্গনের জন্য ব্যগ্র দুবাহু প্রসারিত করতে চায়, তখনও সে না বলে। এবং শেষে যখন নীবিবন্ধ স্পর্শ করে অভিমন্যু, তখন লীলাবতী চিৎকার করে ওঠে।
কেন, কেন? বিভ্রান্ত বিহ্বল দৃষ্টি এবং স্খলিত কণ্ঠস্বর অভিমন্যুর। সে তখনও জানতে চায়, তাহলে আমার অনুমান সত্য–বলো? প্রথমে সেই ব্রাহ্মণ কিশোরটি, তাই না? সেই উপবীতধারী তরুণ গৌরোজ্জ্বল ব্রাহ্মণ বালক তাই না? অতঃপর পিতার প্রভুপুত্রটি তাই না? নাকি প্রতিবেশী কেউ?
লীলার আর সন্দেহ থাকে না। বদ্ধ এক উন্মাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাকে তার পিতা। এর চেয়ে যে মরণ ছিলো ভালো। সে স্বামীর প্রলাপ শুনছিলো এবং প্রতি প্রশ্নের উত্তরে বলছিলো–হা, হ্যাঁ, হ্যাঁ। যতোবার প্রশ্ন ততোবার হ্যাঁ। অভিমন্যু দাস হা হতোস্মি, আমার ভাগ্যে এই ছিলো, বলে শয্যায় পতিত হয়। ঐভাবেই তার অতিক্রান্ত হয়ে যায় কুসুম শয্যার রাত্রিটি।
লীলা আবিষ্কার করেছে, পরে। অদ্ভুত এক জটিল মানসিক অবস্থা অভিমন্যু দাসের। তার একটি কিশোরী ভগিনী ছিলো। সেই ভগিনীটি ছিলো এক ব্রাহ্মণ কিশোরের খেলার সঙ্গীতাকে একদিন এক কায়স্থ যুবক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে সে ফিরে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনও করে। এক প্রৌঢ়ের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী হয়ে সে ভগিনীটি এখন তিন সন্তানের জননী।
কারও কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু অভিমন্যুর এই মানসিক জটিলতাটুকু ছাড়া।
তুমি গবাক্ষ পাশে কেন দাঁড়িয়েছিলে, বলল, কি দেখছিলে? পুষ্পবতীর স্বামী ভীমনাথকে? তোমার তাকে ভালো লাগে? তার সান্নিধ্যে যেতে চাও? সত্যি করে বলো, তুমি যা চাও, তাই হবে।
লীলাবতী দ্বার রুদ্ধ করে, গবাক্ষ রুদ্ধ করে, নিজেকে অন্ধকারে গোপন রাখে–তবু উন্মাদের সন্দেহ। একেকদিন শরীর নিরাভরণ করে কখনও স্তনে অঙ্গুলি নির্দেশ করতো, এটি কে প্রথম মর্দন করেছে বলো, সেই ব্রাহ্মণ কিশোর, নাকি কোনো কায়স্থ লম্পট, নাকি তোমার প্রতিবেশীদের কেউ? কখনও আবার উরুদেশে হাত রেখে জানতে চাইতো, লীলা, এখানে কেন নখরাঘাতের চিহ্ন নেই? সেই ব্রাহ্মণ কিশোর কি নখর রাখতো না?